রায়পুরে বিজ্ঞানযাত্রা: আনন্দ-মুখর এক বিজ্ঞানময় দিন

 লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে গাজী সুপার মার্কেটের সামনে সকাল ৭টায় যখন গিয়ে দাঁড়ালাম, দলের সবার মোটামুটি বিধ্বস্ত অবস্থা। সারারাত নদীর বাতাসে শীতে কাঁপতে কাঁপতে লঞ্চ জার্নি করে ঢাকা থেকে চাঁদপুর গিয়ে, পরে আরো ২ ঘণ্টা সিএনজিতে ভাঙ্গাচোরা রাস্তায় ‘ঝাল চানাচুর’ হতে হতে কারো শরীরে আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই। আমার তো পায়ের গোড়ালিই ভেঙ্গে গেছে মনে হচ্ছিলো। দাঁড়াতেই পারছিলাম না, হাঁটা দূরের কথা। হাঁটার শক্তি নেই বলে সবাইকে হোটেলে খেতে পাঠিয়ে আমি আমাদের বিশ্রামের জন্যে আগেই ব্যবস্থা করা রাখা রুমে এসে শুয়েছিলাম। কিন্তু সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ যখন এক ঝাঁক উৎসুক কিশোর-কিশোরীর মাঝে গিয়ে দাঁড়ালাম, মুহূর্তেই সবাই ভুলে গেলাম সমস্ত ক্লান্তি আর অবসাদের কথা। নতুন করে যেন প্রাণ এসে ভর করলো আমাদের শরীরে। হারানো যৌবন যেন ফিরে পেলো সবাই। সেই যৌবন আর হারিয়ে যায়নি পরের ৮টি ঘণ্টায়। দারুণ আনন্দে আর মজায় মজায় বিজ্ঞানচর্চা করেছিলো বিজ্ঞানযাত্রার সাথে এক ঝাঁক কিশোর বয়সী স্কুল শিক্ষার্থী।

বলছিলাম ‘রায়পুর রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে’ গত ১৬ মার্চ ২০১৮ ইং তারিখে (শুক্রবার) ‘আলোকায়ন’ এবং ‘বিজ্ঞানযাত্রা’-র যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত বিজ্ঞান কর্মশালার কথা। গত ফেব্রুয়ারিতে ঐ স্কুলের শিক্ষক এবং আমার স্নেহভাজন ছোট ভাই রাকিব যোগাযোগ করেছিলো আমার সাথে। সে তাদের স্কুলে একটা বিজ্ঞান-মেলার আয়োজন করতে চায়। ‘আলোকায়ন’ নামের একটা সংগঠন উদ্যোগী হয়ে করতে চাইছে এই প্রোগ্রাম। কবিতা-বিতর্ক-সাহিত্যপাঠ ইত্যাদির পাশাপাশি তাদের জেলায় বিজ্ঞানের আলোও ছড়াতে চাইছে আলোকায়ন সংগঠনের এই এক ঝাঁক তরুণ। যাই হোক, ফেব্রুয়ারির শেষে দিনতারিখ ঠিক হয়েও পরে আবার একটু পিছিয়ে সেটা চলে এলো মার্চ মাসের ১৬ তারিখ, শুক্রবার। এই দিনকে টার্গেট ধরে প্রায় সপ্তাহ দুয়েক ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আমরা। বিজ্ঞানযাত্রার প্রথম বিজ্ঞান-মেলা হয়েছিলো মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে, দ্বিতীয়টা হয়েছিলো চট্টগ্রামের রাউজানে, আর এবারেরটা হবে আমাদের তৃতীয় বিজ্ঞান-মেলা। আগের সেই সব অভিজ্ঞতা থেকে এবারে বেশ ভালোমতোই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম আমরা। সবাই নিজ নিজ কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত। এর মাঝেও তৈরি হয়ে গেলো বিজ্ঞানযাত্রার ১০ জনের একটা দল, যারা যাবে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে। যদিও বিজ্ঞানযাত্রার হেডকোয়ার্টার চট্টগ্রামে অবস্থিত এবং তারা ঢাকা বিজ্ঞানযাত্রার থেকে বেশ সক্রিয়ও, কিন্তু এই আয়োজনে কীভাবে কীভাবে যেন ঢাকা বিজ্ঞানযাত্রা দলে বেশি ভারী হয়ে গেলো! দলের ৮০% সদস্যই দেখা গেলো ঢাকা থেকে আসছে, বাকিরা যাচ্ছে চট্টগ্রাম থেকে। ঠিক হলো, চট্টগ্রাম থেকে সবাই বাসে রওনা করবে। আর ঢাকা থেকে সবাই প্রথমে লঞ্চে করে যাবে চাঁদপুর, পরে সেখান থেকে সিএনজিতে চড়ে যাবে রায়পুরে। লঞ্চে সবার দলবেঁধে যাবার প্ল্যান শুনে চট্টগ্রামের আকাশ-বাতাস একটু ভারী হয়ে উঠেছিলো বটে, কিন্তু এটা নিয়ে আফসোস করার কিছু নেই। চট্টগ্রাম বিজ্ঞানযাত্রা যখন সময়ে সময়ে কর্ণফুলী নদীতে নৌকায় চড়ে বিজ্ঞানাড্ডা করে, তখন ঢাকার আকাশ-বাতাসও একটু ভারী হয়ে উঠে।

যাত্রা হলো শুরু:

যাই হোক, ১৫ তারিখ বৃহস্পতিবার রাত ৮টা নাগাদ ঢাকার সবাই গিয়ে জড়ো হলাম টিএসসিতে। আমাদের লঞ্চ রাত ১২টায়। কিন্তু একটু আগেই চলে গিয়েছিলাম, কারণ বিজ্ঞান-মেলার জন্যে কিছু প্রিন্টিং এবং কেনাকাটার কাজ আছে। সেগুলো একসাথে সারতে হবে। কাজগুলো সেরে রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ হোটেল থেকে কিছু প্যাকেট খাবার নিয়ে পরে উঠলাম রিকশায়। গন্তব্য- সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল। রিকশা গুলিস্তান পর্যন্ত মোটামুটি ভালোই গেলো। বৃহস্পতিবার রাত। রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাঁকা। কিন্তু পুরান ঢাকাতে ঢুকেই শুরু হলো গাড়ির “ঠেলাঠেলি এবং চাপাচাপি”। রাত ১১টা বাজতেই দুনিয়ার ট্রাক নেমে পড়েছে ঢাকার রাস্তায়, আর শুক্র-শনিবারের ছুটি টার্গেট করে সব মানুষ ছুটছে লঞ্চ টার্মিনালের দিকে। বাড়িতে যাবে সবাই। আমাদের ভ্রু কুঁচকে গেলো একটু। ঠিকমতো রাত ১২টার লঞ্চ ধরতে পারবো তো? এর মাঝে হঠাৎ খেয়াল করলাম গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আকাশ কেমন যেন গুমোটও বেঁধে আছে। মুখ শুকিয়ে গেলো আমাদের। এখন একটা কালবোশেখির দমকা হাওয়া ছুটলে? রাতে লঞ্চে যেতেও আবার সমস্যায় পড়বো না তো আবহাওয়া প্রতিকূল থাকলে? যাই হোক, দমকা হাওয়া কিংবা ঝড়ো আবহাওয়া, কোনোটাতেই পড়তে হয়নি। সময়মতোই গিয়ে লঞ্চ ধরতে পেরেছিলাম, আর নিরাপদ ভ্রমণও হয়েছিলো।

লঞ্চে উঠে বসার জায়গা পাবার জন্যে এদিক-সেদিক কতক্ষণ দলবেঁধে ফ্যাঁ ফ্যাঁ করে ঘুরে পরে অবশেষে গিয়ে ঠাঁই গাড়লাম ছাদে। শুনেছি বাংলাদেশে ১২টার লঞ্চ ছাড়ে সাড়ে ১২টায়, সাড়ে ১২টার বাস ছাড়ে রাত ২টায়, আর রাত ২টার ট্রেন ছাড়ে ভোর ৪টায়। কিন্তু আমাদের বিস্মিত করে দিয়ে ঠিক ১২টায়ই লঞ্চ ছেড়ে দিলো। নদীর খোলা বাতাসে এখন সবার মন উদাস করার পালা। কিন্তু বুড়িগঙ্গার পচা পানির বিকট গন্ধে রোমান্টিক মন ঠিক টাইটানিকের সেই পিনিকটা উঠাতে পারছিলো না। ঠিক আছে, টাইটানিকের মতো রোমান্টিক ভাব নাই তুলতে পারলাম, অন্তত “পাইরেটস অব বুড়িগঙ্গা”-ই হই। একটু হই-হুল্লোড় করি। তবে তার আগে দরকার শরীরে শক্তি। তাই লঞ্চের ছাদে সবাই গোল হয়ে বসে তাবলীগী স্টাইলে যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে শেষ করলাম প্যাকেট খিচুড়ি ভক্ষণ।

এরপরে শুরু হলো মাঝ বুড়িগঙ্গায় পাইরেটগিরি। তাস পেটানো, নাচানাচি-দাপাদাপি, আর সাথে সিগারেটে সুখটান দিয়ে এমনিতেই গন্ধওয়ালা বুড়িগঙ্গার বাতাসটাকে আরো বিষাক্ত করে তোলা। মাঝে চট্টগ্রাম বিজ্ঞানযাত্রীদের কয়েক দফায় ফোন দিয়ে তাদের আফসোসটাকে আরেকটু বাড়িয়ে দেয়ার অপচেষ্টা নেয়া হয়েছিলো। কিন্তু লঞ্চ যখন বুড়িগঙ্গা ছেড়ে মেঘনায় পড়লো, পাইরেটগিরি ছুটে গেলো সবার। মেঘনার মতো বিশাল নদীতে মাঝরাতে লঞ্চ ছুটে গেলে সেই উদাসী বাতাস যে শুধু হৃদয়ে না, বরং শরীরেও কাঁপন ধরায়- এটা অনেকেই বুঝতে পারেনি। তাই ঠাণ্ডা বাতাসে এবারে জবুথবু হয়ে বসে রইলো সবাই ছাদের ফ্লোরে। লঞ্চের ভিতরে এয়ার কন্ডিশনড অনেক কম্পার্টমেন্ট আছে। সেগুলোর থেকে গরম বাতাসগুলো বের করে দেয় লঞ্চের ছাদের উপরে ভেসে থাকা এসি-র অংশটুকু। আমরা সবাই এমন একটা এসি-র পাশে গিয়ে ঠাঁই নিলাম। আমাদের নিচের ফ্লোরের মানুষজন বহু টাকা খরচ করে যান্ত্রিক এসির বাতাস খাচ্ছে, আর আমরা প্রাকৃতিক এসির বাতাস হজম করতে না পেরে যন্ত্র থেকে বের হওয়া গরম বাতাসে উম নিচ্ছি! শরীর একটু উম ফিরে পেতেই আবার চাঙ্গা হয়ে গেলো শরীর। শুরু হলো ‘গানের কলি’ খেলার নামে ছাদের পরিবেশ আবার বাকিদের জন্যে যন্ত্রণাদায়ক করে তোলা।

এয়ার কন্ডিশনারের নির্গত বাতাস থেকে গরম খাচ্ছেন পাইরেটরা

রাত পৌনে চারটায় লঞ্চ ভিড়লো চাঁদপুর ঘাটে। আমাদের আগেই সতর্ক করে দেয়া হয়েছিলো, এতো রাতে যেন আমরা গ্রামের ভিতরের দিকে সিএনজি নিয়ে রওনা না করি। পথিমধ্যে লুণ্ঠনকারীদের হাতে পড়ে মালামাল খুইয়ে নিঃস্ব হবার আশংকা আছে। তাই ঘাটের পাশেই একটা রিকশা ভ্যান রাখার জায়গায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম ভোরের আলো ফোটার। সেখানে বসেই একদফা হয়ে গেলো বিজ্ঞানাড্ডা। সেই আড্ডায় সবার মাঝখানে ভ্যানের উপরেই অবশ্য বিজ্ঞানযাত্রী রাসেল লম্বা হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। আড্ডায় কথা হলো রেডিও তরঙ্গ, আলোর তরঙ্গ, ফোটন, কম্পিউটার বিট, বাইনারি সংখ্যা, বজ্রপাত, বায়ুমণ্ডল ইত্যাদি আরো হাবিজাবি বিষয় নিয়ে। এর মাঝে ফোন এসে গেলো ইসমাইলের। তারা নাকি ১২টার গাড়িতে উঠে ৪টাতেই পৌঁছে গেছে রায়পুরে। রাকিবকে ফোন দিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তাদের একটু বিশ্রামের ব্যবস্থার জন্যে বলতে হলো। সে দৌড়ে এসে ব্যবস্থা করে দিলো। এদিকে আমাদের আড্ডার একফাঁকেই অবশ্য রাসেল ঘুম থেকে উঠে গিয়ে এসে বসেছিলো আমার পাশে, কিন্তু আরেক বিজ্ঞানযাত্রী সুদীপ্ত সেটা খেয়াল করেনি। তাই খেয়াল হতেই সে রাসেলকে খুঁজতে লাগলো ভ্যানের নিচে, ওখানে সে কোথাও ঘুমিয়ে পড়ে আছে কিনা সেটা দেখতে!

ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ চড়ে বসলাম সিএনজিতে। রাতভোরে সিএনজিতে অনেক বেশি ভাড়া হাঁকায়। এখন যেতে তো হবেই, কী আর করা! তাই বেশি ভাড়াতে চুক্তি করেই নিয়ে নিলাম ২টা সিএনজি। চাঁদপুর থেকে শুরু করলাম দ্বিতীয় দফায় যাত্রা রায়পুরের দিকে। মোটামুটি এক ঘণ্টার পথ। কিন্তু রাস্তার এমন বেহাল দশা, যেতে লাগে আরো প্রায় আধঘণ্টা থেকে পৌনে একঘণ্টা বেশি সময়। সবচেয়ে বেশি পুলকিত হয়েছিলাম ফরিদগঞ্জ থেকে রায়পুরের রাস্তার একাংশ দেখে। ঐ রাস্তার একপাশে এখনো কিছু পিচ অবশিষ্ট আছে, আর বাকি অর্ধেকে পুরো ভাঙ্গা লাল ইটের টুকরো। মনে হয় যেন, চামচ দিয়ে কাচিয়ে কেউ রাস্তার একপাশ পায়েস বা ডেজার্টের মতো তুলে খেয়ে ফেলেছে!

লঞ্চে মাঝরাতের নদীর খোলা বাতাসে আগেই ছিলাম বিধ্বস্ত, ঠাণ্ডায় পায়ের হাড়ে টনটন ব্যথা শুরু হয়েছিলো। এখন ২ ঘণ্টা ঝালমুড়ি হতে হতে এসে যখন ৭টার দিকে পৌঁছুলাম রায়পুরে, শরীরের তখন শেষ শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই। কিন্তু আমাদের প্রোগ্রাম সকাল ১০টা থেকে। হাতে বেশি সময় নেই জিরোবার। এবারে আমাদের হিংসে হতে লাগলো চট্টগ্রামের বিজ্ঞানযাত্রীদের উপরে। সেই সাড়ে চারটে থেকে নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে তারা। আর আমাদের এখন নাস্তা করতে গেলে একটু দু’চোখ বোজার সময় নেই! গাজী সুপার মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে রাকিবকে আবারো ফোন দিলাম। সে দৌড়ে চলে এলো। এসেই আমাদের শোয়ার ব্যবস্থা করলো। পুরো দলটাকে নিয়ে গেলো সকালের নাস্তা করাতে। আমার পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়েছে। আমি তাই আর যেতে পারলাম না। আমি গিয়ে শুয়ে রইলাম রুমে। ওরা খেয়েদেয়ে আমার জন্যেও নিয়ে এলো নাস্তা। নাস্তা খেয়ে ঘণ্টাখানেক ঘুম দিয়ে নিলাম সবাই।

 

বিজ্ঞানে বিজ্ঞানে একটা আনন্দময় দিন:

সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ আমরা শুরু করলাম আমাদের প্রোগ্রাম। ‘আলোকায়ন’ সংগঠনের উদ্যোক্তারা তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করলেন। তাদের কর্মশালাটা ছিলো ৩ দিনব্যাপী। ১ম দিনে ছিলো বিতর্ক কর্মশালা। ২য় দিনটা রাখা ছিলো বিজ্ঞান কর্মশালার জন্যে, যেটার সহ-আয়োজক হিসেবে ছিলো ‘বিজ্ঞানযাত্রা’। লক্ষ্মীপুর জেলার কয়েকটা স্কুলের শিক্ষার্থীরা এসে জড়ো হয়েছিলো ‘রায়পুর রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ’-এ। আলোকায়নের সদস্যদের বক্তব্যের পরে বিজ্ঞানযাত্রার পক্ষ থেকে গেলাম উদ্বোধনী বক্তব্য দিতে। প্রায় ১৫ মিনিটের আলোচনায় অনেক কিছুই বলতে চেষ্টা করলাম। বিজ্ঞান মানে যে শুধুই রস-কষহীন পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞানের পড়া না, বরং আমরা জীবনের প্রতিটা কাজেই বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মপন্থা অবলম্বন করে নিজেরাও বিজ্ঞান সচেতন হতে পারি, সেটা উদাহরণ দিয়ে মজায় মজায় বুঝালাম। তাদেরকে বারে বারে আশ্বস্ত করা হলো, বোকার মতো প্রশ্ন বলতে কিছু নেই – এই কথাটা বলে। তারাও মনে হয় ধীরে ধীরে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলো। তাদের চোখমুখের ভাষা পালটে যাচ্ছিলো, যত সময় গড়াচ্ছিলো। তারা প্রথমবারের মতো জীবনে উপলব্ধি করতে পারছিলো, আসলে তারা সবাইই সক্ষম বিজ্ঞানের ব্যাপারে জানতে। অনেকে তো সরাসরি বলেও ফেলেছিলো পরে তাদের বিশ্বাসের কথা, তারা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করে না। তারা বিজ্ঞানের কী বুঝবে? কিন্তু আজকের পরে তারা বুঝতে পেরেছে, বিজ্ঞানের পরিধি আসলে ব্যাপক। তারা যেসব বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করছে, সেটাও আসলে বিজ্ঞানই। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছিলো, যখন জেনেছিলাম, উপস্থিত দর্শকদের মাঝে অর্ধেকই আর্টস এবং কমার্সে পড়ুয়া শিক্ষার্থী। বিজ্ঞানকে জানার প্রতি তাদের আগ্রহটা আরো উৎসাহ দিলো আমাদের, দিনটাকে আরো আনন্দময় করে তুলে তাদের বিজ্ঞানের ব্যাপারে আমাদের সর্বোচ্চ জানাটা উপহার দেয়ার জন্যে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, রায়পুরের মতো একটা রক্ষণশীল এলাকায় আমাদের মাঝে উপস্থিত দর্শকদের অধিকাংশই ছিলো মেয়ে। ছেলেরা ছিলো মেয়েদের চেয়ে সংখ্যায় অর্ধেক (ছবিতে তাকালেই বুঝবেন)! তাদেরকে ব্যাপক উৎসাহ দেয়া হলো “বোকার মতো প্রশ্ন” বেশি বেশি করার জন্যে। বক্তব্যের শেষে আমি যখন ব্যাখ্যা সহকারে বললাম, আমরা সবাই আসলে নক্ষত্রের সন্তান, একেকজনের চোখেমুখে বিস্ময় ঠিকরে ঠিকরে বেরুচ্ছিলো।

উদ্বোধনী বক্তব্যের পরে এবারে শুরু হলো আমাদের মূল প্রোগ্রাম। একেকজন বিজ্ঞানযাত্রী এসে শুরু করলেন তাদের বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপনা। প্রথমেই এলো সুশান্ত গ্যালিলিওর পড়ন্ত বস্তুর সূত্র নিয়ে কথা বলতে। দর্শকদের ভিডিও প্রজেক্টরে দেখানো হলো, চাঁদে গিয়ে নভোচারীদের করা গ্যালিলিওর পড়ন্ত বস্তুর সূত্রের পরীক্ষা, নাসার ভ্যাকুয়াম চেম্বারে বিজ্ঞানী ব্রায়ান কক্সের করা একই বিষয়ের উপর পরীক্ষা।

এরপরে এলো সৌরেন এই মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান কোথায়, সেটা হাতে-কলমে দেখাতে। সেই চিত্র ভিডিও প্রজেক্টরে দেখে চক্ষুস্থির সবার। উপলব্ধি করতে পারছিলো সবাই, নিজেদের শ্রেষ্ঠ দাবী করে মারামারি-কাটাকাটি করা এই আমরা আসলে মহাবিশ্বের কাছে একটা ধূলিকণাও না। আমরা সব মরে সাফ হয়ে গেলে তার কিছুই আসবে যাবে না।

এরপরে এলো কৌশিক রায় ‘টেকটোনিক মুভমেন্ট’ নিয়ে। মজায় মজায় উপস্থাপনা করে বুঝানোর চেষ্টা করা হতে লাগলো মহাদেশগুলোর আদি অবস্থা থেকে বর্তমানের রূপ ধারণ করার বিষয়টা। টেকটোনিক প্লেটের বিষয়টা।

এভাবে একসময় বেজে গেলো দুপুর সাড়ে বারোটা, এখন একটা বিরতি দিতে হয়। সবাইকে লাঞ্চ বিরতিতে যেতে বলা হলো, আর ঘোষণা করা হলো, বিরতির পরে থাকছে মজার মজার সব পোস্টার প্রদর্শনী।

দুপুরের বিরতিতে চলছে পোস্টার প্রদর্শনী

 

পোস্টার প্রদর্শনীর সময় যদিও দেয়া হয়েছিলো ২টার পরে, কিন্তু সোয়া একটা থেকেই উৎসুক দর্শকরা এসে ঘুরঘুর করতে থাকলো আমাদের ঝুলিয়ে রাখা পোস্টারগুলোর আশেপাশে। আমাদের তৈরি করা পোস্টারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে হিট হচ্ছে ‘চোখের অন্ধবিন্দুর পরীক্ষা’। ওটার সামনে জড়ো হয়ে তাই সবাই নিজের চোখের অন্ধবিন্দুর পরীক্ষা করতে লাগলো। রাসেল বিপুল বিক্রমে বুঝাতে লাগলো সবাইকে অন্ধবিন্দুর ব্যাপারটা। অন্যান্য বিজ্ঞানযাত্রীরাও পোস্টার ভাগ করে নিয়ে সবাইকে বুঝাতে লাগলো সেগুলোর ভিতরে থাকা ব্যাপারস্যাপার। সুশান্ত প্রিজম আর সাতরঙ বিশিষ্ট ডিস্ক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো নিউটনের রঙের চাকতির পরীক্ষা সবাইকে দেখাতে এবং বুঝাতে যে, সাদা আলো হচ্ছে সাত রঙের সমষ্টি। তাকে উৎসুক জনতা বেশ ঘিরে ধরেছিলো।

লাঞ্চের পরে আমরা আড়াইটায় শুরু করলাম আমাদের দ্বিতীয় সেশন। প্রথমেই দেখানো হলো, ‘মেকিং অব প্ল্যানেট আর্থ’ ডকুমেন্টারির কিয়দংশ। সেখানে মহাদেশগুলো কীভাবে জেগে উঠেছিলো, বরফ যুগ কীভাবে এসেছিলো আর কীভাবেই বা পৃথিবী সেই বরফ যুগকে কাটিয়ে ঊঠেছিলো, তা দেখানো হলো।

এরপরে এলো সুদীপ্ত ‘প্লেন কীভাবে উড়ে’ সেটা ব্যাখ্যা করতে। কয়দিন আগেই নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় অনেকে নিহত হওয়ায় প্রথমে সেখানে নিহতদের সকলের পরিবারের প্রতি শোকজ্ঞাপন করা হলো। এরপরে শুরু হলো উপস্থাপনা। সুদীপ্ত বেশ সুন্দর ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছিলো প্লেনের উড্ডয়নের কারিকুরি।

এরপরে দেখানো হলো Pale Blue Dot ভিডিওটা। ফরহাদ হোসেন মাসুমের চমৎকার বাংলা ডাবিংয়ে কার্ল সেগানের অসাধারণ স্ক্রিপ্টে তৈরি এই ভিডিওটা সবাইকে দেখানো হলো। ভিডিওটা দেখার সময়ে সবার চোখমুখ কেমন নরম হয়ে গিয়েছিলো। হয়তো মনোজগতে চিন্তার ঝড় উঠেছিলো তাদের। ভাবছিলো এই পৃথিবীতে হাস্যকর সব জাতপাত ও শ্রেণীবিভাজনের নামে হিংসা ও যুদ্ধের ব্যাপারগুলো। ভিডিওটা দেখার সময়ে কার্ল সেগানকে হালকা পরিচয়ও করিয়ে দেয়া হয়েছিলো তাদের সাথে।

এরপরে মঞ্চে এলো আমাদের দলের একমাত্র নারী বিজ্ঞানযাত্রী কাসপিয়া। সে এসে সবাইকে শুনালো আধুনিক কম্পিউটারের ইতিহাস। এককালের একটা বিশাল রুম ভর্তি কয়েক কিলোবাইট সাইজের কম্পিউটার আজ কীভাবে হাতের তালুতে এঁটে যাওয়া কয়েক টেরাবাইটের একটা যন্ত্রে এসে দাঁড়িয়েছে, সেই গল্প।

এরপরে ছিলো আমার পালা। শুরু হলো উপস্থিত দর্শকদের জেনেটিক্সের পাঠদান। মেন্ডেলের সূত্রের ব্যাখ্যা, এবং জেনেটিক রোগ কীভাবে কয়েক প্রজন্ম সুপ্তাবস্থায় থেকেও হুট করে এক প্রজন্মের এসে প্রকাশ পেতে পারে, সেই আলোচনা। এই আলোচনার সূত্র ধরে রাসেল উঠে এসে শুনালো কিছু উদ্দীপক কথাবার্তা। কেউ কালো কিংবা বেঁটে বলেই যে তাকে নিজেকে খাটো মনে করতে হবে না, সেই ব্যাপারে দারুণ সব কথামালা।

এরপরে রাসেল এগিয়ে এলো ‘নক্ষত্রদের জীবনচক্র’ নিয়ে কথা বলার জন্যে। কোন সাইজের নক্ষত্র কীভাবে জন্মায় এবং কীভাবে তার মৃত্যু ঘটে, সেই সংক্রান্ত মজার আলোচনা।

পুরো বিজ্ঞানমেলায় এস.এ.খান পালাই পালাই ভাব করছিলো। সে দর্শকদের সামনে প্রেজেন্টেশন দিবে না। কিন্তু আমিও লেগেছিলাম তার পিছনে। সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরা চালু ছিলো তার উপরে। কড়া মনিটরিংয়ে রাখা হচ্ছিলো তাকে। তাই আর পালানোর রাস্তা না পেয়ে অবশেষে উঠতে হলো তাকে মঞ্চে। আলোচনা করা হলো স্পেস-স্যুটের আদ্যোপান্ত নিয়ে। দারুণ হয়েছিলো সেই আলোচনা। অনুষ্ঠানের শেষে তার বক্তব্য, তাকে স্টেজে উঠিয়ে ভুল করেছি আমি। ভীষণ মজা পেয়েছে সে প্রেজেন্টেশন করে। এখন থেকে কোনো বিজ্ঞানমেলায় তাকে স্টেজ না দিলে সমস্যা আছে আমার!

এরপরে প্রদর্শিত হলো আরেকটা ভিডিও। সেই ভিডিওতে দেখানো হলো, আমরা যেভাবে পৃথিবীটা দেখি, আসলেই কি পৃথিবীটা তেমন? নাকি আমাদের চোখের দেখার বাইরেও আরো অনেক অদৃশ্য জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের আশপাশে? বিভিন্ন প্রকারের তরঙ্গের কাজ, গাছেদের বৃদ্ধিসহ অনেক কিছুই দেখানো হলো তাতে।

এবারে অর্ণবের পালা। সে এসে ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করলো বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং তার ভয়াবহতা। ভিডিওতে দেখানো হলো বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ভয়াবহ সব চিত্র।

সবশেষে এলো ইসমাইল। সে এসে আলোচনা করলো আমাদের প্রচলিত সব বিশ্বাস বনাম বিজ্ঞানের সত্য ও সুন্দরের লড়াই নিয়ে। জ্যোতিষশাস্ত্র, কুসংস্কারসহ অনেক কিছুই উঠে এলো তার আলোচনায়। ইসমাইলের কথার ভঙ্গিটা বেশ মজার। দর্শকরা হাসতে হাসতে বেশ গড়াগড়ি খেলো তার সারকাস্টিক উপস্থাপনায়। সেই সাথে এও বুঝতে পেরেছিলো, আমাদের মুরুব্বিরা আমাদের যা শেখান, তার সবই ঠিক নয়। অনেক অন্ধবিশ্বাস আছে তাতে, আছে হাস্যকর সব কুসংস্কার।

অনুষ্ঠানের সমাপনীতে বিজ্ঞানযাত্রার পক্ষ থেকে আলোকায়ন সংগঠনকে উপহার দেয়া হলো একগাদা বই। উপহার গ্রহণ করেছিলেন সংগঠনের দুই মুখপাত্র, টিটু ভাই এবং রাকিব। তাদেরকে অনুরোধ করে আসা হলো, ভবিষ্যতে কোনো একসময় যাতে তারা রায়পুরে একটা পাবলিক লাইব্রেরি স্থাপনের চিন্তা মাথায় রাখে। আর বিজ্ঞানযাত্রার পক্ষ থেকে রায়পুর রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজকে উপহার দেয়া হলো বিজ্ঞানভিত্তিক পোস্টার। আমাদের আশা, পোস্টার তারা স্কুলের কোথাও ঝুলিয়ে রাখবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা সেটা দেখতে পাবে আসা যাওয়ার মাঝে।

বিজ্ঞানযাত্রার থেকে উপহার হিসেবে বই গ্রহণ করছেন আলোকায়নের সদস্যরা

সমাপনীতে এবারে বিজ্ঞানযাত্রার জন্যে সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিলো। রাকিব এসে একে একে ডাকলো উপস্থিত দর্শকদের মাঝে কয়েকজনকে। আজকের প্রোগ্রামটার ব্যাপারে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করতে বলা হলো। তাদের একেকজনের কথা শুনে আবেগে বুকটা পুরো দশ হাত ফুলে গিয়েছিলো। সবার মুখেই একই কথা। তারা কেউই আজকের বিজ্ঞানের প্রোগ্রামের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলো না। কিন্তু এখানে এসে আজ সারাদিন আমাদের সাথে সময় কাটিয়ে তাদের সেই মনোভাব পুরো পালটে গেছে। তারা বুঝেছে, বিজ্ঞান কারো বাপের সম্পত্তি না। এটা সবার জন্যেই উন্মুক্ত, সবার জন্যেই জরুরি। তারা ঘুণাক্ষরেও ধারণা করেনি, একটুও বোর ফিল না করে এভাবে পুরো একটা দিন অনর্গল বিজ্ঞানভিত্তিক সব বক্তৃতা এবং ভিডিও উপভোগ করা যায়।

তাদের কথা শুনে মনে হলো, আমাদের সারাদিনের পরিশ্রম সার্থক। সবাই ভুলে গেলাম সমস্ত শারীরিক কষ্টের কথা। অনুষ্ঠানের শেষে সব কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েগুলোর চোখ যেভাবে কৌতূহল এবং নতুনকে জানার আগ্রহে জ্বলজ্বলে করছিলো, জানি না আঁধারে ভরা এই সমাজে সেই দীপ্তিটা কতোদিন তাদের চোখে জ্বলতে সক্ষম হবে। এই ক্ষেত্রে মনে হয় আলোকায়নের মতো সংগঠনগুলোর ভূমিকাটা জরুরি। বিজ্ঞানযাত্রা হয়তো স্কুলে স্কুলে গিয়ে জ্বালাবে বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাচেতনার আগুন, কিন্তু সেটা নিভে না যেতে দেয়ার দায়িত্বটা নিতে হবে এদেরকেই।

প্রোগ্রামটার টিভি নিউজ কাভারেজ লিংক এখানে