গণিতশাস্ত্রের দুর্ধর্ষ ১০ – ১ম পর্ব

 গণিত! মহাবিশ্বের বিশাল কর্মযজ্ঞের পেছন-কার প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্বরূপ উদঘাটনকারী ব্যক্তিদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ একটা শাস্ত্র। অত্যন্ত জ্ঞানী এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্বরূপ নিয়ে মোটামুটি চিন্তিত, এমন গুটিকয় ব্যক্তির প্রথম ভালোবাসা। আর বাকি সাধারণ আই-কিউ বিশিষ্ট ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্বরূপ নিয়ে মাথা না ঘামানো ‘দিন এনে দিন খাই’ টাইপ আমজনতার সামনে এক মূর্তিমান আতংক। গণিত হচ্ছে এক রহস্যে ঘেরা গহীন অরণ্যের মতো। উপরে বর্ণিত তিন শ্রেণীর মানুষেরা এই গহীন অরণ্যের রহস্যের সাথে তিনভাবে মোকাবিলা করেন। প্রথম শ্রেণীরা চান অরণ্যের ওপাশে ঐ উঁচু পাহাড়ে কী আছে, সেটা দেখতে। কিন্তু এজন্যে তাদের পেরুতে হবে গণিতের সেই গা ছমছমে, গুরু-গম্ভীর সবুজের প্রান্তরটাকে। তারা তাই করেন। যতটুকু পথ প্রয়োজন, ততটুকু পথ মাড়িয়ে তারা পৌঁছে যান বনের ওপাশে আকাশছোঁয়া পাহাড়টার নিকট। এদিকে শেষের শ্রেণীর মানুষেরা নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন বনটার বিশালতার দিকে। বনের বাইরে দাঁড়িয়েই তারা কানে স্পষ্ট শুনতে পান ভেতর থেকে ভেসে আসা বাঘ-ভাল্লুকের হুংকার। পা আর একচুলও নড়ে না তাদের। বনের বাইরেই স্থির দাঁড়িয়ে থাকেন তারা।

কিন্তু সবচেয়ে দুর্ধর্ষ হলেন মাঝের শ্রেণীর ব্যক্তিরা। তাদের দূর পাহাড়ের গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া নেই। তারা মুগ্ধ হয়ে পড়েন রহস্যঘন বনটাকে নিয়ে। সেখান হতে ভেসে আসা গুরু-গম্ভীর সব ডাক তাদের রক্তে শিহরণ জাগায়। অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় তারা তখন কোমরে একটা ছুরি গুঁজেই ঢুকে পড়েন সেখানে। আঁধারে ছেয়ে থাকা গা ছমছমে অরণ্যের প্রতিটা লতা-পাতা, শাখা-প্রশাখায় তারা বিচরণ করে বেড়ান অবাক বিস্ময় নিয়ে। টারজানের মতো খালি হাতে পিটিয়ে মারেন ডাঙ্গার বাঘ, আর জলের কুমীরদের। আমাদের আজকের আয়োজন মাঝের এই দুর্ধর্ষ শ্রেণীর দুর্ধর্ষতর কয়েকজন অভিযাত্রীদেরকে নিয়ে, যারা গণিতশাস্ত্র চর্চা করে গিয়েছিলেন শুধুমাত্র নিখাদ মুগ্ধতা ও ভালোবাসা হতে। সেই পথ আদৌ তাদের বনের ওপাশে কোনো গন্তব্যে নিয়ে পৌঁছাবে কিনা, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাননি তারা। গণিতশাস্ত্রের এমন দুর্ধর্ষ ১০ জনের কথা তুলে ধরা হলো এই সিরিজে।

(প্রতিটা ব্যক্তির ইতিহাসের সাথে একটা করে রেটিং জুড়ে দিয়েছি ‘জাস্ট ফর এক্সট্রা ফান’। কিন্তু সত্যি কথা হলো, তাদেরকে বিচার করার সাধ্য আমার নেই। কারোরই নেই। তাহলে কেন এই রেটিং? যদি ৫ম পর্ব পর্যন্ত ধৈর্য ধরে থাকতে পারেন, তাহলে বুঝবেন!)

১০। আর্যভট (৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ-৫৫০ খ্রিস্টাব্দ)

কে ছিলেন তিনি?
প্রাচীন ভারতের এক প্রতিভাধর গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তাঁর জন্মস্থান নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে অনেক ইট-পাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ি হয়েছিলো এবং হয়ে চলেছে। তাঁর জন্মস্থান ধরা হয় প্রাচীন ‘অশ্বকা’ নামক স্থানে। এই স্থানকে নিয়ে বর্তমানে তামিলনাড়ু হতে শুরু করে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সবখানেই টানা-হেঁচড়া চলছে। সবারই দাবী তাদের উল্লেখিত স্থানের প্রাচীন নাম ছিলো ‘অশ্বকা’। তিনি পরে বিদ্যার্জন করতে তৎকালীন ‘কুসুমাপুরা’ (বর্তমানে ‘পাটনা’) গিয়েছিলেন এবং পরে সেখানকার এক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অনেকে তাঁর নামে ‘ভট্ট’ লিখেন, যেটা ভুল। তাঁর নামের প্রকৃত উচ্চারণ ‘আর্য-ভ-ট’

aryabhata-3

কেন তিনি দুর্ধর্ষ?
শূন্যের আবিষ্কারক হিসেবে যেসব ভারতীয় গণিতবিদের নাম ধরা হয়, আর্যভট হচ্ছেন তাঁদের একজন। এর আগে চাইলেও অংকের খাতায় শূন্য পাওয়া সম্ভব ছিলো না। হ্যাঁ, তখনো অংকে ফেইল করা যেতো। কিন্তু সে ফেইলে ছিলো না কোনো গৌরব! ডাবল জিরো পেয়ে গৌরবজনক রেকর্ড ঘটানোর মতো ঘটনার সূত্রপাত তখনো ঘটেনি। পরে আর্যভট এসে শূন্যের ধারণার প্রচলন করেন, আর গণিতে এক নবদিগন্তের সূচনা হয় (আর্যভট শুধু শূন্যের ধারণা দিয়েছিলেন। বৃত্তাকার চিহ্ন মারফতে শূন্যকে প্রথম লিখতে শুরু করেছিলেন ‘ভাস্কর‘, যিনি সরাসরি আর্যভটের ছাত্র)। শুধু এই কারণেই দুর্ধর্ষ গণিতবিদের তালিকায় তাঁর নাম আসা উচিৎ। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়।

তিনি ভারতীয় গণিতশাস্ত্রে সংখ্যাদের স্থানাংকের (অর্থাৎ একক-দশক-শতক-সহস্র-অযুত-লক্ষ-নিযুত ইত্যাদি ইত্যাদি) ধারণা প্রচলন করেন। তবে তিনি সংখ্যা লিখতে ১, ২, ৩ ইত্যাদি ব্যবহার করেননি। তিনি ব্যবহার করেছিলেন ব্রাহ্মীলিপির অক্ষরদের (অনেকটা রোমান I, II, III………….IX, X- এর মতো)। মাত্র ২৩ বছর বয়সে লিখে ফেলেছিলেন ‘আর্যভট্ট’ নামক এক তৎকালীন “বেস্টসেলার” বই। বইয়ের নামটা তিনি দেননি। তাঁর সাগরেদরাই পরে গুরু ‘আর্যভট’-এর আলোচিত সব তত্ত্বের এই সংকলনটাকে নাম দিয়েছিলেন ‘আর্যভট্ট’। এই বইয়ে আলোচিত হয়েছিলো পাটিগণিত, বীজগণিত, সমতল ত্রিকোণমিতি, গোলকীয় ত্রিকোণমিতি, রেলগাড়ির মতো চলতে থাকা সব ভগ্নাংশদের চরিত্র, দ্বি-ঘাত সমীকরণ, সূচক বিশিষ্ট সংখ্যাদের সিরিজের যোগফল নির্ণয় সহ বর্তমানে একটা স্কুল-পড়ুয়া বাচ্চার শৈশবের পুরো ‘তেষ’ মারতে যা যা প্রয়োজন তার সবই।

সেই সাথে লিখেছিলেন ‘আর্যসিদ্ধান্ত’ নামক এক জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত বইও। ভারতীয়দের মাঝে আর্যভট সর্বপ্রথম পাইয়ের মান দশমিকের পর চার ঘর পর্যন্ত (৩.১৪১৬) নির্ভুল গণনায় সক্ষম হন। শুধু তাই নয়। তিনিই প্রথম উপলব্ধিতে আসেন- পাইয়ের এই মান আসলে ১০০% খাঁটি নয়। বরং এটা ‘আসন্ন মান’। ৩.১৪১৫……… এর পরেও আরো সংখ্যা আছে, যেগুলো তখনো বের করা যাচ্ছিলো না। যদি ইতিহাসবিদদের এই বক্তব্য সঠিক হয়, তবে বলা যায়- ১৭৬১ সালে গণিতবিদ ‘ল্যাম্বার্ট’ নয়, বরং আর্যভটই বহু শতাব্দী আগে পাই যে একটা ‘অমূলদ সংখ্যা’ সেটা ধরতে পেরেছিলেন।

তিনি ত্রিভুজ ও বৃত্তের ক্ষেত্রফলের সূত্র প্রদান করেন। ৮ম ও ৯ম শতকের আরবের গণিতবিদেরা আর্যভটের কাছে চরমভাবে ঋণী। তাঁরা বীজগণিত ও ত্রিকোণমিতিতে সরাসরি আর্যভটের রেখে যাওয়া গ্রন্থ ‘আর্যভট্ট’-এর সহায়তা নিয়েছিলেন। গণিতবিদ ‘আল-খোয়ারিজমি’ তাঁর বীজগণিতের বইয়ে সরাসরি আর্যভটের নাম উল্লেখ করেছিলেন। এদিকে ‘আল-বিরুনী’ তাঁর জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত লেখায় উল্লেখ করেছিলেন আর্যভটের ‘আর্যসিদ্ধান্ত’ বইয়ের সহায়তার কথা।

আর্যভট উল্লেখ করে গিয়েছিলেন ‘জ্যা’ এবং ‘কোজ্যা’-দের কথা। বিভিন্ন ডিগ্রীর কোণের জন্যে এই জ্যা এবং কোজ্যা-দের মানের একটা বিশাল তালিকাও তৈরি করে দিয়ে গেছিলেন তিনি। এই জ্যা এবং কোজ্যা-ই হলো আজকের ত্রিকোণমিতির ‘Sine’ এবং ‘Cosine’. কিন্তু ‘জ্যা – কোজ্যা’ এর নাম ‘Sine – Cosine’ হয়ে গেলো কীভাবে? যখন আরবের গণিতবিদেরা আর্যভটের বই অনুবাদ করেছিলেন, তখন তাঁরা জ্যা-এর আরবি অনুবাদ করেছিলেন ‘Jba’, যেটা আরো পরে লাতিনে অনুবাদের সময়ে হয়ে গেছিলো ‘Jiba’. লাতিনে যারা অনুবাদ করেছিলেন, তারা ধরে নিলেন এটা আসলে Jiba নয়, এটা হচ্ছে আরবি শব্দ Jaib- যার মানে হচ্ছে জামার পকেট। জ্যা কে দেখতে যেহেতু কিছুটা পকেটের মতো দেখায়, তাই লাতিন বিশেষজ্ঞরা ধরে নিলেন আর্যভট জ্যা (পরে আরবিতে Jba, Jiba এবং Jaib) বলতে পকেটের সাথেই তুলনা বুঝিয়েছেন। ফলে সেই সাথে নাম মিলিয়ে তারা মূল Sinus শব্দ হতে জ্যা-এর এর ল্যাটিন নাম রাখলো ‘Sine’। এর মানে হচ্ছে জামার কিনারের ভাঁজ। কোজ্যা-এর নাম হয়ে গেলো ‘Cosine’.

তিনি দ্বি-ঘাত সমীকরণ সমাধানের আরো সহজ উপায় বাতলে দিয়েছিলেন। তাঁর পদ্ধতিতে এই সমীকরণদের ধাপে ধাপে ভেঙ্গে সমাধান করতে হয়। এদিকে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানেও দেখিয়েছিলেন তাঁর গাণিতিক প্রতিভার ঝলক। যে সময়ে মানুষেরা বিশ্বাস করতো পৃথিবী একটা থালার ন্যায় সমতল, আর তার নিচে চারটা হাতি সেই থালাকে ধরে আছে, ঠিক সেই সময়ে আর্যভট দাবী করলেন- পৃথিবী গোলাকার। শুধু তাই নয়। তিনি নিখুঁতভাবে পৃথিবীর পরিধি নির্ণয় করেছিলেন, যদিও তার অনেক বছর আগেই গ্রীক গণিতবিদ ও বিজ্ঞানী এরাটোসথিনিস সেটা নির্ণয় করেছিলেন। তাঁর মাপ অনুযায়ী পৃথিবীর পরিধি পাওয়া গেছিলো ৪৯৬৭ যোজন। ১ যোজন = ৫ মাইল। তাহলে ৪৯৬৭ যোজন = ২৪,৮৩৫ মাইল। আধুনিক হিসাবে এই মান ধরা হয় ২৪,৯০২ মাইল। এখানেও তিনি থেমে থাকেননি। তিনিই সর্বপ্রথম দাবি করেন যে পৃথিবী তার নিজ অক্ষের উপরে ঘুরছে! ফলে দেখা যায় তারারাও আকাশে এক স্থান হতে আরেক স্থানে বিচরণ করে চলছে। তিনি এও বলেন পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহদের কক্ষপথ আসলে উপবৃত্তাকার। তাঁর শিষ্যরা (ভাস্করব্রহ্ম গুপ্তবরাহমিহির) এসব ‘বিস্ফোরক’ মার্কা বক্তব্য ঠিক হজম করতে পারেননি। তখনকার প্রচলিত মতবাদ ছিলো- পৃথিবী স্থির, আকাশ ঘোরে। তাই তাঁর মৃত্যুর পরে যখন তার রেখে যাওয়া পুস্তক নিয়ে তারা অধ্যয়ন করেন, তাদের পেটের ভিতরে মোচড় মেরে ওঠে গুরুর এসব ‘আবোল-তাবোল’ বক্তব্য পড়ে। তখন কেউ যাতে তাঁকে ‘নাস্তিক’ দাবি করে তার ‘পু/ফাঁসি’ চাইতে না পারে, সেজন্য ভাস্কর, ব্রহ্ম গুপ্ত, বরাহমিহির প্রমুখ পণ্ডিতেরা গুরুর লেখাগুলোকে ‘ভাইরাল’ হয়ে যাবার আগেই কেটে-ছিঁড়ে ফর্দাফাঁই করে নিজেদের পছন্দমতো আবার নতুন করে লিখে দেন। এভাবেই তারা সমাজে তাদের গুরুর ইমেজ রক্ষা করেন!

কাটাছেঁড়ার পর আর্যভটের জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিভিন্ন মডেলের গাণিতিক অবস্থা।

কাটাছেঁড়ার পর আর্যভটের জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিভিন্ন মডেলের গাণিতিক অবস্থা।

সেই সময়ে আরো বিশ্বাস ছিলো- সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হয় ‘রাহু’ এবং ‘কেতু’ নামক দুই অশুভ শক্তির প্রভাবে। আর্যভট সেই তত্ত্বকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলেন- সূর্যগ্রহণ হয় পৃথিবী আর সূর্যের মাঝখানে চাঁদ ঢুকে পড়ায়, এবং চন্দ্রগ্রহণ হয় চাঁদের উপরে সূর্যের আলোর কারণে পৃথিবীর ছায়া পড়ায়। বলাই বাহুল্য, তাঁর এসব তত্ত্ব সেই সময় হালে পানি পায়নি। ফলে আরো বহু শতাব্দী ধরে ভারত উপমহাদেশের মানুষ ‘রাহু’ ও ‘কেতু’ নামক দুই অশুভ শক্তির ভয়ে প্যান্ট নষ্ট করে ফেলতে ব্যস্ত ছিলো।

দুর্ধর্ষতা রেটিং
শূন্যের আবিষ্কারক হিসেবে হাতে শূন্যের মতো একটা দুর্ধর্ষ সংখ্যা ধরিয়ে দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করার আকাঙ্ক্ষা ছিলো আমাদের। কিন্তু যেহেতু প্রচলিত অর্থে এটার মানে দাঁড়ায় উলটো, তাই তাঁকে বাধ্য হয়ে রেটিং দেয়া হলো ৭.৫/১০। কারণ তিনি বৃত্তের ও ত্রিভুজের ক্ষেত্রফলের সঠিক সূত্র প্রদান করলেও, গোলক ও পিরামিডের আয়তন নির্ণয়ের যে সূত্রসমূহ প্রদান করেছিলেন সেগুলো ছিলো ভুল। তদুপরি তিনি সৌরজগতের ‘ভূ-কেন্দ্রিক’ মডেলে বিশ্বাস করতেন। পৃথিবীর ঘূর্ণন, গ্রহদের উপবৃত্তাকার কক্ষপথ এবং চন্দ্রগ্রহণ-সূর্যগ্রহণের মতো ব্যাপারে ব্যাখ্যা প্রদানে সক্ষম ব্যক্তির পক্ষে এটা মারাত্মক অপরাধ। তাই বেশ খানিকটা পয়েন্ট কেটে নেয়া হলো।

৯। আর্কিমিডিস (২৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ – ২১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)

কে ছিলেন তিনি?
প্রাচীন গ্রীসের গণিতবিদ। তাঁকে ধরা হয় প্রাচীন যুগের গণিতবিদদের মাঝে সেরা হিসেবে। কেউ কেউ আরেকটু আগ বাড়িয়ে তাঁকে সর্বকালের সেরা গণিতবিদের মেডেলটাও দিয়ে দেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন পদার্থবিদ। ছিলেন একজন প্রকৌশলী। একজন উদ্ভাবক। আরও ছিলেন একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী।

archimedes (1)

কেন তিনি দুর্ধর্ষ?
অনেকের ধারণা ক্যালকুলাসের সূত্রপাত মধ্যযুগে; গোটফ্রীড লিবনিজ, আইজ্যাক নিউটন প্রমুখ বিজ্ঞানীদের হাত ধরে। কিন্তু আসলে এর গোড়াপত্তন করেছিলেন আর্কিমিডিস, যখন তিনি গণিতে ‘ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র (Infinitesimal)’ ধারণার প্রবর্তন করেন। শুধু তাই নয়। ‘সূচক (Power)’-এর ধারণার জনকও তিনি। এর আগে মানুষ খুব বেশি বড় সংখ্যা কল্পনা করতে সাহস পেতো না। কিন্তু আর্কিমিডিস এসে ব্রহ্মাণ্ডের তাবৎ সংখ্যাকে, তা যতো বড়ই হোক না কেন, “পোর্টেবল সাইজে” নিয়ে এলেন সূচকের ধারণার মাধ্যমে। তিনি একটা সংখ্যার ঘাড়ের উপর আরেকটা সংখ্যাকে কুলির বস্তার মতো চাপাতে শুরু করলেন।

পাইয়ের মান নিখুঁতভাবে বের করেছিলেন আর্কিমিডিস। তাঁর একটা গুণ ছিলো- তিনি কোনো সমস্যার অনেকগুলো সম্ভাব্য সমাধান হতে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে অবান্তরগুলোকে বাদ দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারতেন। শুধু তাই নয়। কোন সীমানা পর্যন্ত ঐ সমাধানটা সঠিক থাকবে, সেটাও তিনি উল্লেখ করে দিতে পারতেন। যুক্তিতর্কের এই ধারাটাকে বলা হয় ‘Method of Exhaustion’. এই ধারা দিয়েই তিনি নিখুঁতভাবে পাইয়ের মান বের করতে সক্ষম হন।

পাইয়ের মানের পাশাপাশি গণিতে তাঁর সবচেয়ে বেশি যে অবদানগুলোর কথা উল্লেখিত হয়, সেগুলো হলো- বৃত্তের ক্ষেত্রফলের সূত্র আবিষ্কার করা, গোলক এবং বেলনের (সিলিন্ডারের) আয়তন ও পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল নির্ণয় করা। শুধু তাই নয়। একই ব্যাসার্ধ এবং উচ্চতাবিশিষ্ট বেলন ও গোলকের মধ্যে যে একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে, সেটাও দেখিয়েছিলেন তিনি। তিনিই প্রথম প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন একই ব্যাসার্ধ এবং উচ্চতাবিশিষ্ট গোলক-বেলন জুটিতে গোলকের আয়তন বেলনের আয়তনের তিন ভাগের দুই অংশ। তাদের পৃষ্ঠদেশের ক্ষেত্রফলেও একই কথা প্রযোজ্য। তিনি তাঁর এই আবিষ্কার নিয়ে এতোই মুগ্ধ ছিলেন যে, তিনি বলে গিয়েছিলেন- তাঁর কবরের সমাধিফলকে যেন এই বেলন ও গোলক জুটিকে স্থান দেয়া হয়।

তিনি সরাসরি ‘লিভার (Lever)’ এর কৌশল আবিষ্কার না করলেও এর মূলনীতি এবং গাণিতিক ব্যাখ্যা প্রদানে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর এই লিভার প্রযুক্তির উন্নতিকরণ নিয়ে তিনি নিজেই মন্তব্য করেছিলেন, “আমাকে একটুখানি দাঁড়ানোর জায়গা দাও। আমি পুরো পৃথিবীকেই নাড়িয়ে দিবো”।

download
এতো কিছুতেও যদি আর্কিমিডিসের দুর্ধর্ষতা প্রমাণিত না হয়, তবে উল্লেখ করা যায় তাঁর ‘মহাবিশ্ব ও বালুকণা’ সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে চিন্তা-ভাবনার কথা। আর্কিমিডিস ব্যাপক চিন্তা-ভাবনার পর এক পর্যায়ে উপলব্ধিতে আসেন- এই পুরো মহাবিশ্বকে (অন্তত তখন পর্যন্ত মহাবিশ্ব সম্পর্কিত ধারণা যতটুকু ছিলো) ৮ x ১০^৬৩ সংখ্যক বালুর কণা দিয়ে ভরে ফেলা যাবে! তিনি এই সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছিলেন পৃথিবী, সূর্য, চাঁদ ও অন্যান্য গ্রহদের মধ্যেকার দূরত্ব নিখুঁতভাবে মেপে।

গণিতের একনিষ্ঠ সাধক এই প্রতিভার মৃত্যুও হয়েছিলো গণিতের মাঝে ডুবে থেকেই। ইতিহাসবিদ ‘প্লুটার্ক (Plutarch)’-এর লেখা হতে জানা যায়, ‘দ্বিতীয় পুনিক যুদ্ধ’-এর সময় রোমান জেনারেল ‘মার্কাস ক্লডিয়াস’ গ্রীসের সাইরাকিউজ দখল করে নেন। তারপর তিনি তার এক সৈন্যকে পাঠান আর্কিমিডিসকে ধরে নিয়ে আসার জন্যে। তার মূলত ইচ্ছা ছিলো এই মহান গণিতবিদকে সামনা-সামনি দেখবেন এবং তাঁর পায়ের ধুলো নিজ মাথায় মাখবেন। কিন্তু তার পাঠানো সৈন্য গিয়ে বিশাল তাফালিং শুরু করে দিলো আর্কিমিডিসের সাথে। আর্কিমিডিস তখন মাটিতে বৃত্তের ছবি এঁকে সেটার জ্যামিতিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন একমনে। জেনারেলের পাঠানো সৈন্যের হুকুম তাঁর কাছে ঘ্যানঘ্যানানির মতো লাগলো। তিনি জবাবে বললেন- সে যেন মাটিতে তাঁর আকা বৃত্তের ছবির উপর থেকে সরে গিয়ে একপাশে দাঁড়ায়। আর যেন পারলে পরে কোনো এক সময় আসে। কারণ এই মুহূর্তে তিনি গণিতের সমস্যা সমাধান নিয়ে ব্যস্ত। এমন জবাবে কাপ-ঝাঁপ করতে থাকা সৈন্যের মেজাজ পুরো বিলা হয়ে গেলো। যেতে অস্বীকৃতি জানিয়ে জেনারেলকে এভাবে অসম্মানিত করায় সে তরবারি খাপ থেকে খুলে সেটা বসিয়ে দিলো আর্কিমিডিসের বুকে। তিনি সেখানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। পরে সৈন্যটা ফিরে গিয়ে নিজ জেনারেলকে গৌরবের সাথে বলতে লাগলো- কীভাবে সে ঐ বেয়াদবটাকে শাস্তি দিয়েছে! জবাবে জেনারেলের রুদ্রমূর্তি দেখে আস্তে-আস্তে গলার কণ্ঠ খাদে নেমে গিয়েছিলো তার। সৈন্যটার কপালে পরে কী জুটেছিলো, সেটা আর প্লুটার্কের ইতিহাসে জানা যায়নি।

জেনারেল মার্কাস- তার প্রেরিত সৈন্যের উদ্দেশ্যে

জেনারেল মার্কাস- তার প্রেরিত সৈন্যের উদ্দেশ্যে

তবে এটা জানা গিয়েছিলো যে- গণিতশাস্ত্রের এই হিরোকে যথাযোগ্য মর্যাদায় দাফন করা হয়েছিলো সিরাকিউজে। তাঁর কবরের সমাধিফলকে স্থাপন করা হয়েছিলো ‘গোলক-বেলন’ জুটিকে, গণিতের প্রতি তাঁর অসামান্য ভালোবাসা ও অবদানের স্বীকৃতি দিয়ে, তাঁরই ইচ্ছানুসারে। মধ্যযুগে ইউরোপে যে ক’জন প্রাচীন মনীষীর রেখে যাওয়া পুস্তক রেনেসাঁ ঘটাতে সহায়তা করেছিলো, তাঁদের একজন ছিলেন আর্কিমিডিস!

দুর্ধর্ষতা রেটিং
(২^৩)/১০। পুরো মহাবিশ্বকে বালুকণা দিয়ে ঢেকে ফেলার গাণিতিক চিন্তা-ভাবনা করার কারণে তাঁকে দশে দশ দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু তিনি মহাবিশ্বের যে মডেল কল্পনা করেছিলেন, সেটা এখন পুরোপুরি বাতিল হয়ে যাওয়া এক মডেল। সুতরাং তাঁর গণনাকৃত বালু কণার সংখ্যা ৮ x ১০^৬৩ ফলাফলটাও ভুল। সেই হিসেবে দশে আট।

(দ্বিতীয় পর্ব)