অলৌকিক ঘটনাবলী এবং তাদের বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যাসমূহ- শেষ পর্ব

আগের পর্বে আমরা ভূতুড়ে ঘটনা ঘটার পেছনের কিছু বৈজ্ঞানীক ব্যাখ্যা জেনেছিলাম। সেখানে আমরা দেখেছিলাম কিভাবে একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ চোখের সামনে ছায়ামূর্তির মত অবয়ব দেখতে পারে। কিন্তু ভূতেরা এত রঙ্গে, রূপে এবং ফ্লেভারে আসে যে শুধু ছায়ামূর্তি দেখার মত ঘটনা ব্যাখ্যা করলেই সব শেষ হয়ে যায় না। অনেক ভূতুড়ে ঘটনা আছে যেখানে অদ্ভুত সব শব্দ এবং বাজনা কানে ভেসে আসে। কখনোবা দেখা যায় একসাথে অনেক মানুষ ভূত দেখা শুরু করেছে। কিংবা প্রায়ই ঘুম ভেঙ্গে দেখেন অশুভ কিছুর প্রভাবে আর বিছানা ছেড়ে শোয়া থেকে উঠতে পারছেন না। আজকের পর্বে সেইসবের ব্যাখ্যা দিয়েই আমরা আমাদের এই প্রবন্ধ শেষ করবো।

৬। কার্বন মনোক্সাইড বিষক্রিয়া (Carbon Monoxide Poisoning)

চক্ষু বিশেষজ্ঞ ‘উইলিয়াম ভিলমার (William Wilmer)’ ১৯২১ সালে ‘আমেরিকান জার্নাল অব অফথালমোলজি’তে একটা আজব ধরণের গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন। সেই গবেষণাপত্রে তিনি একটা পরিবারের ভেতরে ঘটে যাওয়া ঘটনা উল্লেখ করেছিলেন। সঙ্গত কারণেই তিনি পরিবারটির নাম প্রকাশ করেননি। তিনি তাদের পরিবারকে সম্বোধন করেছিলেন ‘এইচ (H)’ আদ্যাক্ষর দিয়ে।

তো আমাদের এই ‘এইচ’ পরিবার যে বাড়িতে বসবাস করছিলেন সেই বাড়ি কিভাবে কিভাবে যেন ভূতের আড্ডাখানা হয়ে গিয়েছিলো। তাদের বাড়িতে দরজা-জানালা অযথাই ধড়াম ধড়াম শব্দ করে বন্ধ হয়ে যেত। রুমের আসবাবপত্রগুলো নড়াচড়া করতো। আর সবচেয়ে বড় এবং বিরক্তিকর ব্যাপার যেটা সেটা হলো বাড়ির খালি কক্ষগুলোতে কারো হাঁটাচলার এবং দৌড়াদৌড়ির শব্দ পাওয়া যেত। ঐ পরিবারের এক শিশু একবার স্পষ্ট অনুভব করেছিলো তার কোলের উপর কে যেন বসে আছে। আরেকবার এক প্রাপ্তবয়স্ক সদস্য দেখলেন অপরিচিত কে যেন তাকে মারতে তেড়ে আসছে! এক রাতে ঐ বাড়িরই এক মহিলা সদস্য দেখলেন তার বিছানার পাশে একজন পুরুষ এবং আরেকজন মহিলা যুগলবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু খানিকবাদেই তারা অদৃশ্য হয়ে গেলো।

haunted-house (1)
মানুষ যেরকম একটা হাসির ব্যাপার দেখে শুরুতে খুব হাসলেও এক পর্‍যায়ে ব্যাপারটা একঘেয়ে হয়ে দাঁড়ায়, ভয় কিংবা আতংকের ব্যাপারটাও তেমনি। আপনি কোন একটা জিনিস দেখে যতই ভয় পাননা কেন, ঘন ঘন দেখতে দেখতে এক পর্‍যায়ে সেটাও বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু এইক্ষেত্রে সাথে বোনাস হিসেবে পাবেন হতাশা এবং বিষন্নতা। আমাদের সেই ‘এইচ’ পরিবারের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো। এক পর্‍যায়ে পুরো পরিবার বিষন্ন এবং হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু তারা এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতেও পারছিলো না।

ঠিক এমন সময় তাদের হতাশাগ্রস্ত জীবনে আলো হয়ে এলো একটা ছোট্ট আবিষ্কার। পরিবারের একজন দেখলো তাদের বাড়ির ফার্নেসটাতে মারাত্মক ত্রুটি আছে। ফার্নেসটার কাজ ছিলো বাড়ির ভেতরের সব বিষাক্ত গ্যাসকে চিমনি দিয়ে বাইরে বের করে দেয়া। কিন্তু এর বদলে সে গ্যাসকে ছড়িয়ে দিচ্ছিলো সারা বাড়ি। দেখা গেলো আমাদের পুরো ‘এইচ’ পরিবার কার্বন মনোক্সাইড বিষক্রিয়ার শিকার!

কার্বন মনোক্সাইড (CO) হচ্ছে গন্ধবিহীণ, বর্ণবিহীন বিষাক্ত গ্যাসীয় পদার্থ। উন্মুক্ত পরিবেশে এই গ্যাসকে সহজে শনাক্ত করা যায় না। আমাদের মানবশরীরের রক্ত যত সহজে অক্সিজেন শোষণ করতে পারে ঠিক তত সহজেই কার্বন মনোক্সাইডও শোষণ করে ফেলতে পারে। এর ফলে দেখা দেয় শারিরীক দূর্বলতা, বমি বমি ভাব, দুশ্চিন্তা, মানসিক অস্থিরতা ইত্যাদির মত উপসর্গ। রক্তে এই বিষক্রিয়ার মাত্রা সামান্য একটু বেশি হলে মানুষ মারাও যেতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় ব্যাপার যেটা সেটা হলো মৃত্যুর দিকে আগানোর সাথে সাথে এই বিষক্রিয়ায় আপনার ভেতরে হ্যালুসিনেশানের মাত্রাও বাড়তে থাকবে

১৯২১ সালে কোন একটা জার্নালে কার্বন মনোক্সাইডের বিষক্রিয়াজনিত ক্ষমতা প্রকাশ পাওয়া আর ২০১৫ সালে মঙ্গলে বহমান পানির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া একইরকম চমকপ্রদ ঘটনা। কারণ রোগীর পশ্চাৎদেশ দিয়ে তামাকের ধোঁয়া প্রবেশ করানো সেই আমলের ডাক্তারদের নিকট খুবই জনপ্রিয় চিকিৎসা ছিলো! অনেক ডাক্তার রোগীদের ধূমপানের ব্যাপারেও উৎসাহ দিতেন।

mtjtsppiu0uj4zgvzeu9
যাই হোক, রসিকতা ছেড়ে মূল বক্তব্যে ফিরে যাই। এখন প্রশ্ন হল- কার্বন মনোক্সাইডের উৎস কি কি হতে পারে? উপরেতো একটা পেলেন যে ত্রুটিপূর্ণ ফার্নেস হতে কার্বন মনোক্সাইডের বিষক্রিয়া ছড়াতে পারে। আরেকটা হচ্ছে সিগারেট। এছাড়াও আরো হতে পারে ডিজেল এবং পেট্রোলচালিত গাড়ি ও যন্ত্রপাতি, গ্যাসের চুলা এবং লাকড়ির চুলা। একটা দরকারী তথ্য হচ্ছে- যে চুলায় আগুনের শিখা নীল সেই চুলার থেকে হলুদ আগুনের শিখাবিশিষ্ট চুলা সাধারণত বেশি কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন করে থাকে। এর মানে এই নয় যে নীল শিখার চুলায় কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন হয় না। অবশ্যই হয়, কিন্তু পরিমাণে কম।

২০০৫ সালে একজন মহিলা ৯১১ তে ফোন দিয়ে বললেন তার বাথরুমে নাকি তিনি ভূত দেখতে পাচ্ছেন। পরে খুঁজে দেখা গেলো বাথরুমের ওয়াটার হিটারে লিক আছে যেটার মাধ্যমে পুরো ঘর কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসে ভরে যাচ্ছিলো।

সুতরাং এরপরে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে কিংবা কোন খালি বাড়িতে কৌতূহলবশত উঁকি মেরে দেখতে গিয়ে যদি ধুপধাপ লাফালাফির শব্দ, প্রেতাত্মাদের রক কনসার্টের বাদ্য-বাজনার শব্দ শুনতে পান আর ছুরি হাতে কাউকে তেড়ে আসতে দেখেন, তাহলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবার আগে সেখানে কার্বন মনোক্সাইড জাতীয় বিষাক্ত গ্যাসের অস্তিত্ব আছে কিনা সেটা নিশ্চিত হয়ে নিন। আর জেনে রাখুন- “ধুমপান জ্বিন-ভূত দেখার জন্যে উপকারী”!

৭। ফসফিন (Phosphine) এবং মিথেন (Methane)

যারা গ্রামাঞ্চলে থাকেন তারা ব্যপারটা ভালো জানেন। রাতের আঁধারে টর্চ নিয়ে পুকুরে আর ডোবার কিনারায় কিনারায় ঘুরছেন মাছ ধরার জন্যে। কিংবা মাছ ধরা নয়, এমনিতেই বাড়ির বাইরে বেরিয়েছেন কোন কাজে। হঠাৎ দেখলেন ডোবার ধারে জঙ্গলের মত জায়গায় এক টুকরো আলো ভেসে বেড়াচ্ছে। সেটা এদিক সেদিক বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিশ্চয়ই পরীর কাজ! যারা সাহসী তারা একটু এগিয়ে গেলেন পরীটাকে ধরতে। কিন্তু দূর্ভাগ্য, কাছে যেতেই আপনার উপস্থিতি টের পেয়ে আলোটা নিভে গেলো। পরী আপনাকে দেখে উড়ে চলে গেছে!

ইংরেজিতে এই আলোটাকে বলে ‘Will-o’-the-wisps’. বাংলায় ডাকা হয় ‘আলেয়া’ নামে। এর আগে একটা ভূতুড়ে ঘটনার ব্যাখ্যায় আপনাদের নিয়ে গিয়েছিলাম মাইকেল ফ্যারাডের কাছে। আজকে চলুন যাই ‘আলেজান্দ্রো ভোল্টা (Alessandro Volta)’র সাথে দেখা করতে। ১৭৭৬ সালে আলেজান্দ্রো ভোল্টা সর্বপ্রথম মিথেন গ্যাস আবিষ্কার করেন। তিনিই সর্বপ্রথম সন্দেহ করেছিলেন আলেয়ার আলোর মত ভূতূড়ে ঘটনার পেছনে মিথেন গ্যাসের হাত আছে। তাঁর সেই তত্ত্বই পরে আধুনিক বিজ্ঞানের ধারণা দিয়ে আরো নিখুঁত ও পরিশোধিত হয়েছে।

Volta_A
পৃথিবীর সব গাছপালা, পশু-পাখি, মানুষ মূলত জটিল হাইড্রোকার্বন জৈবযৌগের সমন্বয়ে গঠিত। এইসব জৈবযৌগের মূল উপাদান কার্বন, হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন। এইসব জৈবযৌগ যখন উন্মুক্ত পরিবেশে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে পঁচতে থাকে তখন বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে তৈরি হয় পানি, কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং কিছু পরিমাণ তাপ। কিন্তু যখন এইসব জৈবযৌগ পঁচার সময় উন্মুক্ত পরিবেশের অক্সিজেন পায় না তখন? ধরুন এরা খোলা বাতাসে পঁচার বদলে কোন পুকুর বা ডোবার পানির নিচে পঁচছে- সেই ক্ষেত্রে কি হবে? তখন বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে তৈরি হবে মিথেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন, ফসফিন ইত্যাদি।

এই মিথেন এবং ফসফিন গ্যাস যখন পানি ছেড়ে বুদবুদের মাধ্যমে ভেসে উঠবে এবং খোলা বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসবে তখন মিথেন গ্যাস ফসফিনের সাথে বিক্রিয়া করে নীল আলো উৎপন্ন করবে যেটাকে দেখা যাবে আশেপাশের বাতাসে ভেসে বেড়াতে। ফসফিন হচ্ছে দাহ্য গ্যাস যেটা বাতাসের সংস্পর্শে এলে স্বতস্ফূর্তভাবে জ্বলে উঠে। যখন ফসফিন বাতাসে জ্বলতে থাকে তখন এটা সাদা ধোঁয়ার সৃষ্টি করে। ফলে সেই নীল আলোর চারপাশে একটা ধোঁয়ার মত অবয়ব চোখে পড়াও বিচিত্র কিছু নয়। যখন কেউ সেটাকে ধরতে যাবে তখন তার উপস্থিতিতে মিথেন এবং ফসফিন গ্যাসের মিশ্রণটা চারপাশে ছড়িয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। ফলে আলোটাও হারিয়ে যাবে। সুতরাং পরী ধরতে না পারার জন্যে দুঃখ করার কোনো কারণ নেই!

Wisp_full
প্রত্যেকটা দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেই এইসব আলেয়ার আলো নিয়ে অনেক বিচিত্র কিংবদন্তী ও গল্প প্রচলিত আছে। সবকটাতেই এই আলোর বিশাল অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপারগুলো বেশ চটকদারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু আলজান্দ্রো ভোল্টার মত রস-কষহীন বিজ্ঞানীরা এসে যথারীতি পুরো ব্যাপারটার অলৌকিক মাহাত্ম্যকে পা দিয়ে পিষে মেরে ফেলেছেন।

৮। গণহিস্টেরিয়া (Mass Hysteria)

২০১৩ সালে বাংলাদেশের গাজীপুরের এক ফ্যাক্টরির প্রায় ৩০০০ গার্মেন্টসকর্মী কর্মবিরতি ঘোষণা দিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিলো। তারা বেতন বৃদ্ধি কিংবা বকেয়া বেতন আদায়ের দাবিতে কোন আন্দোলনের কারণে রাস্তায় নেমে আসেনি। তারা রাস্তায় আন্দোলনে নেমেছিলো কারণ তাদের ফ্যাক্টরির ‘মহিলা টয়লেটে’ ভূতের উপদ্রব হয়েছিলো! একটা ভয়ংকর রাগী ভূত নাকি মহিলা টয়লেটে ঢুকে সেখানকার মহিলাদের উত্যক্ত করে যাচ্ছিলো। কর্তৃপক্ষকে বারবার জানানোর পরেও এই ‘ইভ টিজার’ ভূতের বিরুদ্ধে তারা কোন আইনী উদ্যোগ নেয়নি। নারী নির্‍যাতন আইনে মামলা দায়ের দূরের কথা, নিদেনপক্ষে একটা ওঝা ডেকে ঝাড়ফুঁক করানোরও প্রয়োজনবোধ করেনি। ফলে যা হবার তাই হলো। ৩০০০ শ্রমিক রাস্তায় নেমে গাড়ি ভাংচুর শুরু করলো! পরে দাঙ্গা পুলিশ দিয়ে বহু কষ্টে পরিস্থিতি সামাল দেয়া গেছিলো।

RMG-unrest_article_5_1
কাছাকাছি আরেকটা ঘটনা ঘটেছিলো থাইল্যান্ডের ফুকেট প্রদেশের পাতং নামক এলাকায়। সেখানে একসাথে ২২ জন ছাত্রছাত্রীকে মেডিকেলে ভর্তি করানো হয়েছিলো কারণ তারা সবাই একটা মহিলার অশরীরি প্রেতাত্মাকে দেখতে পেয়েছিলো। বাংলাদেশের ঐ ফ্যাক্টরি মালিক পরে তাবিজ-কবজ দিয়ে বাথরুম বন্ধ করে দিলেও থাইল্যান্ডের ঐ ঘটনার সুরাহা কি হয়েছিলো তা আর জানা যায়নি।

উভয়ক্ষেত্রেই যেটা ঘটেছিলো তা হলো- আসলে সবাই গণহিস্টেরিয়ার শিকার হয়েছিলো। এই ধরণের ঘটনা ঘটে শুধুমাত্র সেইসব পরিবেশে যেখানে সবাই প্রচন্ড মানসিক চাপে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ধন্যবাদ জানাতে হয় এখানকার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোতে ১২-১৫ ঘন্টা শিফটিং ডিউটির জন্যে। আর থাইল্যান্ডের ঐ ঘটনায় ধন্যবাদ প্রাপ্য বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বেঁধে দেয়া কঠোর নিয়ম-কানুনের জন্যে। এই মাত্রাতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে শুরু হয় মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব এবং হঠাৎ করে মেজাজ চড়ে যাবার মত উপসর্গের। সেই সাথে যোগ করুন এক মুঠ ধর্মীয় এবং সামাজিক বিশ্বাস, বহির্জগত হতে বিচ্ছিন্ন এক কর্মপরিবেশ আর এক চিমটি গুজব ও কানকথা। তারপর ভালোমত ঘুঁটা দিলে যে জিনিসটা দাঁড়ায় সেটাই হলো গণহিস্টেরিয়া।

বাংলাদেশের ঐ ফ্যাক্টরীর ঘটনায় পরে তদন্তে জানা গিয়েছিলো ৩০০০ শ্রমিক-কর্মচারীর মধ্যে অতি অল্প সংখ্যক মানুষই টয়লেটে ঐ ‘ইভ টিজার’ ভূতটাকে দেখেছিলো। এমনকি যেই মহিলা শ্রমিকটা প্রথম ভূত দেখে আতংক ছড়িয়ে সবাইকে রাস্তায় নামিয়েছিলো সেও পরে স্বীকার করেছিলো যে ভূতটাকে সে নিজের চোখে দেখেনি। সে বাথরুমে গিয়ে কোন কারন ছাড়াই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলো। পরে যখন তাকে সেখান হতে উদ্ধার করা হলো তখন সেই সবাইকে জানিয়েছিলো- এটা আসলে কোন জ্বিনের কাজ (জ্বিন হলেও একটু ‘লুচ্চা’ টাইপের জ্বিন, শুধু মহিলা টয়লেটে ঢুকে নারীদেরকে হয়রানি করে- এই আর কি)! কিন্তু সেই জ্বিনতত্ত্বই এত শক্তিশালী হয়ে সবার মাথায় বাসা বেঁধেছিলো যে আরো দুই একজন পরে বাথরুমে মাথা ঘুরে পড়ে গেলে সেই তত্ত্ব ভিত্তি পেয়ে যায় এবং আতংকে এক বিশাল জনগোষ্ঠী হিস্টেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে রাস্তায় নেমে ভাংচুর শুরু করে।

সৌভাগ্যক্রমে পরবর্তীতে শুধু তাবিজ দিয়ে ঐ ফ্যাক্টরির বাথরুম বন্ধ করেই রক্ষা পাওয়া গিয়েছিলো। মহামতি লুসিফারের উদ্দেশ্যে কোন পশু কিংবা নরবলি দেয়ার প্রয়োজন পড়েনি!

৯। আয়ন (Ions)

আয়ন হচ্ছে পদার্থের অণু যেটাতে প্রোটন এবং ইলেক্ট্রনের সংখ্যা ভারসাম্যাবস্থায় নেই। যদি কোন অণুতে অতিরিক্ত ইলেক্ট্রন যোগ হয় তবে সেটা ঋণাত্মক আধানবিশিষ্ট হয়। আর যদি অনু তার ইলেক্ট্রন হারায় তবে সেটা ধ্বনাত্মক আধানবিশিষ্ট হয়।

কোনো পরিবেশে মাত্রাতিরিক্ত আয়নের উপস্থিতি ঘটলে সেখানে ভূতুড়ে সব ঘটনা ঘটতে থাকে। যেমন- অশুভ কোনকিছুর অস্তিত্ব টের পাওয়া হতে শুরু করে আচমকা একটা ছায়াকে ঘরের কোণায় সরে যেতে দেখা হয়ে বিচিত্র সব আওয়াজ শুনতে পাওয়া পর্যন্ত যেকোন কিছু।

এই ব্যাপারে প্যারাসাইকোলজিস্টদের ‘বিজ্ঞানভিত্তিক(!)’ ব্যাখ্যা হচ্ছে- ভূতেরা হলো আসলে এক প্রকার এনার্জি বা শক্তি। তারা যখন অন্য জগত হতে আমাদের দৃশ্যমান জগতে আবির্ভূত হয় তখন তাদের শনাক্ত করা যায় সেখানকার পরিবেশে আয়নের সংখ্যা গণনা করে। আর এই কাজে প্যারাসাইকোলজিস্টরা ব্যবহার করেন ‘আয়ন কাউন্টার (Ion Counter)’। সব প্রফেশনাল প্যারাসাইকোলজিস্টরাই এই যন্ত্র ব্যবহার করে ভূতুড়ে সব জায়গায় অতি উচ্চমাত্রার আয়ন শনাক্ত করে অশরীরিদের উপস্থিতি প্রমাণ করে থাকেন।

nkmh-103-large
এখন চলুন শুনি গবেষকদের কথা, যারা ল্যাবরেটরিতে নিয়মিত ‘আয়ন’ এবং ‘আয়ন মাপার যন্ত্র’ নিয়ে কাজ করে থাকেন। তাদের মতে– এসব যন্ত্রপাতি হচ্ছে ল্যাবে বৈজ্ঞানীক পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্যে। ভূত-প্রেত শনাক্ত করার জন্যে নয়। যুক্তি হিসেবে বলা যায়, অতিমাত্রায় আয়নের উপস্থিতি যদি অশরীরিদের অস্তিত্ব প্রমাণ করে থাকে তাহলে বৈজ্ঞানীক গবেষণাগারগুলো হলো সব ভূতেদের আখড়া। আর সেই হিসেবে ‘সার্ন (CERN)’ এর ল্যাবরেটরি হওয়া উচিৎ ভূতেদের হেডকোয়ার্টার।

মূল ব্যাপার হলো প্রকৃতির সবখানেই এসব আয়ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কোথাও কোথাও বিশেষ কোন কারণে আয়নের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। সেটা খারাপ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণেই হোক কিংবা ফুটো হয়ে যাওয়া ওজোনস্তর দিয়ে বিকিরিত ক্ষতিকর সব সৌররশ্মির অনুপ্রবেশের কারণেই হোক। অনেকসময় রেডনের মত নিষ্ক্রিয় গ্যাসের কারণেও প্রকৃতিতে মাত্রাতিরিক্ত আয়নের উৎপত্তি ঘটতে পারে।

বিজ্ঞানযাত্রার পাঠক হিসেবে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব আয়নের একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার কথা গোপনে জেনে রাখুন। এরা সর্বদা আপনার মন-মেজাজকে নিয়ন্ত্রণ করে চলছে। যে পরিবেশে ঋণাত্মক বা নেগেটিভ আধানের সংখ্যা বেশি সেখানে সাধারণত আপনি বেশি ফুরফুরে ও শান্ত মেজাজে থাকবেন। আর যে পরিবেশে ধ্বনাত্মক বা পজিটিভ আধানের সংখ্যা বেশি সেখানে আপনি মাথাব্যথা হতে শুরু করে সহজেই তীব্র অবসাদে আক্রান্ত হবেন। এটাই সম্ভবত সবচেয়ে বড় যুক্তি যে- কেন ভূতুড়ে বাড়িতে বসবাসকারীরা সবসময় তীব্র মাথাব্যথা, অস্থিরতা এবং অবসাদে ভোগেন।

১০। স্লিপ প্যারালাইসিস (Sleep Paralysis)

জীবনে কতবার ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখেছেন একটা বীভৎস শয়তানের মত কিছু আপনার বিছানার পাশে বসে আছে আর সেটা শক্ত করে আপনাকে বিছানার সাথে চেপে ধরে রেখেছে? আপনি নড়তে পারছেন না, এমনকি মুখ ফুটে শব্দও বের হচ্ছে না। কেউ হয়তো একবার, কেউ দুইবার বা তিনবার জীবনে এই ধরণের ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন। কেউ কেউ আবার এইধরণের ঘটনার নিত্যদিনের সাক্ষী। যারা পরের ক্যাটাগরিতে পড়েন তাদের দশা একপ্রকার করুণই বলা চলে। তাদের গলায় পাঁচ পদের, হাতের বাহুতে সাত পদের আর কোমরে তের পদের তাবিজ-কবজ সর্বদা বয়ে নিয়ে চলতে হয়।

কিন্তু এই ঘটনা ঘটার কারণ কি? কেন হঠাৎ জ্বিন-পরীরা আপনার প্রতি এত আকৃষ্ট হয়ে পড়লো? ঘটনা আর কিছুই না- স্লিপ প্যারালাইসিস

যারা স্লিপ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়েছেন কিন্তু প্যারালাইজড অবস্থায় থাকার সময় বিছানার পাশে দুই-চারটা জ্বিন-পরী বসে থাকতে দেখেননি তাদের সংখ্যা ‘পুরোপুরি শূন্য’। পৃথিবীর প্রত্যেকটা স্লিপ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিই তার মাথার কিংবা পায়ের দিকে অশুভ কিছু একটা বসে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকার অস্তিত্ব অনুভব করেছেন।

Nightmare-Lucid-Dream-851x1024
আসল ঘটনায় যাবার আগে আমরা কিভাবে ঘুমাই সেটা একটু বলে নেই। আমরা যতক্ষণ জেগে থাকি এবং কাজ করি আমাদের শরীরে ‘এডেনোসিন (Adenosine)’ জমতে থাকে  এবং আমরা একটু একটু করে ক্লান্ত হয়ে পড়তে থাকি। যখন আমরা ঘুমাই তখন মূলত এই এডেনোসিনগুলো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হতে থাকে। আমরা যখন ঘুমাবার জন্যে শুই তখন শরীরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘মেলাটোনিন (Melatonin)’ হরমোনের মাত্রা বাড়তে থাকে। এর কাজই হলো পুরো শরীরে তন্দ্রাভাব এনে দেয়া। আবার যখন শরীর জাগতে শুরু করে তখন মেলাটোনিন সরে গিয়ে সেখানে ভীড় করতে শুরু করে ‘কর্টিসল (Cortisol)’। এই হরমোনের কাজ হলো শরীরকে জানান দেয়া যে ঘুম মোটামুটি ফুরিয়ে এসেছে।

ঘুমের সময় আমাদের শরীরকে প্যারালাইজড করে রাখা হয় আমাদের নিরাপত্তার স্বার্থেই (আপনার পাশে যিনি শুয়ে আছেন তার নিরাপত্তাও এইক্ষেত্রে বিবেচ্য)। এই ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্ক চক্রাকারে পাঁচটা ধাপ অতিক্রম করে। স্টেজ-১, স্টেজ-২, স্টেজ-৩, স্টেজ-৪ এবং রেম স্লিপ (Rapid Eye Movement Sleep)। এর মধ্যে স্টেজ-১ হলো সবচেয়ে হালকা ঘুম। আর স্টেজ-৪ হলো সবচেয়ে ভারী ঘুম। এই স্টেজের ঘুমে থাকা মানুষগুলোকে জাগানো খুব কঠিন।

স্লিপ প্যারালাইসিস ঘটে তখনই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন শরীর জাগার আগেই আমাদের মস্তিষ্ক পুরোপুরি জেগে উঠে। যখন সে টের পায় শরীর এখনো জেগে উঠেনি তখন শুরু হয় হ্যালুসিনেশান। শরীর কেন জেগে উঠেনি সেটার ব্যাখ্যা দাঁড়া করাতে সে ঘোরের ভেতরে থেকেই জ্বিন-পরী-ভূত ইত্যাদি আপনার আশেপাশে পয়দা করতে শুরু করে। কিন্তু যখনই আপনার শরীরে অনুভূতি ফিরতে শুরু করে তখনই দেখবেন এইসব ভূতেরা একে একে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।

অনেক সময় স্লিপ প্যারালাইসিসের উলটো ঘটনাও ঘটে। এটাকে বলে ‘হিপনিক মায়োক্লোনিয়া (Hypnic Myoclonia)’। এইক্ষেত্রে মস্তিষ্ক পুরোপুরি জাগার আগেই শরীর জেগে উঠে। ফলে দেখা যায় সেই অশুভ আত্মারা আপনার হাত কিংবা পা ধরে হ্যাঁচকা টান মারছে, বিছানা হতে টেনে ফেলে দিচ্ছে, কিংবা আদর করে(!) মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। সর্বনিম্ন ক্ষেত্রে দেখা যায়, আপনার মনে হচ্ছে কেউ আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে, অথচ আপনি বিছানার উপরেই শুয়ে আছেন। এই ব্যাপারটা ঘটে থাকে স্টেজ-১ এর ঘুমে থাকার সময়। অর্থাৎ স্টেজ-১ এর ঘুমে থাকার সময় শরীর আচমকা জেগে ওঠার ব্যাপারটা অনেকটা কোন গাড়ি সরাসরি তৃতীয় কিংবা চতুর্থ গিয়ারে স্টার্ট করার মতো। যারা গাড়ি কিংবা বাইক চালান তারাই ব্যাপারটা বুঝবেন।

যেহেতু এখন স্লিপ প্যারালাইসিস সম্পর্কে জানলেন সুতরাং এটা নিয়ে এখন আর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এটা পুরোপুরি স্বাভাবিক একটা ঘটনা। কিন্তু যারা একটু বেশি ভুগছেন এই ধরণের সমস্যায় তারা জলদি ডাক্তার দেখান। এটা আপনার ঠিকমত ঘুম না হওয়াজনিত সমস্যা।

কিভাবে ভয় না পেয়ে স্লিপ প্যারালাইসিস হতে ধীরে ধীরে জেগে উঠবেন সেটা জানতে হলে যান এই লিংকে

(শেষ)