“মহাশূন্য শব্দটা বলতে আমরা কী বুঝি?” একবার এক পরিচিত চা-বিক্রেতাকে এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিলো- একজন বিজ্ঞান-যাত্রী হিসেবে সমাজে বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা-ভাবনা ছড়িয়ে দেয়া, যাতে পরে সবার সামনে ঘটনাটা বলে একটু ভাব নিতে পারি। ভেবেছিলাম আর সবাই যা বলে, তিনিও তাই বলবেন। হয়তো বলবেন- মহাশূন্য হচ্ছে এমন একটা জায়গা যেখানে সব গ্রহ-নক্ষত্ররা থাকে। কিন্তু উত্তরে সেই চা-বিক্রেতা আমার অর্ডার করা রঙ চায়ের জন্যে আদা কুচি করতে করতে জবাব দিলেন, “মামা, মহাশূইন্য হইতাসে খালি প্যাঁচ আর প্যাঁচ। এইডারে তো এক কথায় বুঝায়া কইতে পারুম না”।
আমি ভ্রু কুঁচকে শুধালাম, “প্যাঁচ কেন? আমি তো দেখি মহাশূন্য পুরা খালি। জায়গায় জায়গায় শুধু কয়েকটা গ্রহ আর তারা”।
তার জবাব ছিলো, “হের লাইগ্যাই তো প্যাঁচ বেশী। যে জিনিসের ভিত্রে যত খালি, ঐডার ভিত্রে প্যাঁচ তত বেশী। দেহেন না মহাখালী কত্ত বড় একটা জায়গা। কিন্তুক গাড়ি সব প্যাঁচে আটকাইয়া রইছে!” এই বলে তিনি রাজধানী ঢাকার মহাখালীর রাস্তায় ইঞ্জিন বন্ধ করে আধঘণ্টা ধরে ঝিমাতে থাকা বাস আর গাড়িগুলোর দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করলেন।
আমি আর বিজ্ঞান প্রচারে বিশেষ উৎসাহ পেলাম না। বললাম, “চায়ের সাথে একটা গোল্ড লীফও দিয়েন”।
পরে গোল্ড লীফ টানতে টানতে মাথা যতই পরিষ্কার হতে লাগলো, ততই বুঝতে পারলাম চা-বিক্রেতা মামার কথার মাহাত্ম্য। আসলেই তো! মহাশূন্য তো এত সহজে ব্যাখ্যা করে ফেলার জিনিস না। বরং আমরাই এটার সহজ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উলটো ভুলভাল অনেক কিছু শিখে বসে থাকি। যারা প্রকৃত বিজ্ঞান ভক্ত তারা পরে আরো পড়াশোনা করে সেই ভুলগুলো কাটিয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু যারা প্রাইমারী বা হাইস্কুলের পরে আর বিজ্ঞান পড়েননি, তারা সেই সাধারণ ভুলগুলোই সঠিক জেনে বসে থাকেন। যেমন-
৫। ধূমকেতু সবসময় তার লেজের বিস্তারের উল্টো পাশে ছুটে চলে
জলদি করে জবাব দিন- নীচের ছবির ধূমকেতুটা কোনদিকে যাচ্ছে?
যদি আপনার জবাব হয়, “ডানপাশের নীচের কোণার দিকে”- তাহলে আপনি ভুল বলেছেন! যদি কোনো একটা দিক বাছাই করে উত্তর দেন, তাহলে সেটাও ভুল। কিন্তু যদি বলেন, “জানি না”- তাহলে সেটাই সঠিক উত্তর। আসলেই এই ছবির ধূমকেতুটা কোনদিকে যাচ্ছে, সেটা কোনোরকমের গাণিতিক বিশ্লেষণ না করে শুধু ছবি দেখে আপনি কখনোই সঠিক উত্তর দিতে পারবেন না।
আমরা সাধারণত ধরেই নেই- ধূমকেতুর লেজ যেদিকে প্রসারিত হয়েছে, ধূমকেতুটা তার উল্টো পাশে দৌড়ুচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ধূমকেতুরা সব একেকটা বিশাল বরফের খণ্ড। আর এই বরফের খণ্ডের বাইরে বাকী যা কিছু দেখছেন, তার সবই হচ্ছে সূর্যের আলোর ভাঁওতাবাজি। লেজের বিস্তারের উল্টোদিকে আসলেই ধূমকেতু দৌড়াচ্ছে কিনা- সেটার কোনো গ্যারান্টি কেউই এত সহজে দিতে পারবে না। কিন্তু এর কারণ কী?
নীচের ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন একটা ধূমকেতুর গঠনতন্ত্র। ছবিতে দেখুন- এর মূল বরফ এবং প্রস্তরের শরীর, অর্থাৎ নিউক্লিয়াস খুবই ক্ষুদ্র। মাত্র ১ থেকে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। যখন এই ক্ষুদ্র নিউক্লিয়াসটা দৌড়াতে দৌড়াতে সূর্যের পাঁচ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল মাইলের ভিতরে চলে আসে (১ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল মাইল = ৯৩ মিলিয়ন মাইল = সূর্য হতে পৃথিবীর গড় দূরত্ব), তখন সূর্যের তাপে সেই ক্ষুদ্র নিউক্লিয়াস হতে কিছুটা পরিমাণ বরফ কঠিন অবস্থা হতে সরাসরি গ্যাসীয় অবস্থায় রূপান্তরিত হয়। সেই গ্যাসের সাথে মিশে যায় ধূমকেতুর কিছু ধূলিকণা। এই দুয়ে মিলে নিউক্লিয়াসের চতুঃপার্শ্বে তৈরি করে এক ধূম্রজাল। এই ধূম্রজালের নাম হচ্ছে ‘কোমা (Coma)’।
ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন এই কোমা এলাকার বিস্তার ৫০,০০০ মাইল পর্যন্ত হতে পারে। সূর্যের আলো এই কোমা এলাকার ধূম্রজালের উপরে পড়ে বলেই বিশাল ‘দুটো’ লেজ তৈরি হয়। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। ধূমকেতুর লেজ একটা নয়, দুটো! একটা লেজ ধূলিকণা দিয়ে তৈরি। এটাকে বলে ‘ডাস্ট টেইল (Dust Tail)’। আর আরেকটা লেজ তৈরি আয়ন দিয়ে। এই আয়ন কোথা থেকে আসে? একটু আগেই যে বলেছিলাম মনে আছে- বরফ গলে কিছু গ্যাস তৈরি হয়? সেই গ্যাস কণাগুলোকে যখন সৌর-বায়ু আঘাত করে, তখন সেগুলো আয়নে পরিণত হয়। আয়ন দিয়ে তৈরি এই আরেকটা লেজকে বলে ‘ আয়ন টেইল (Ion Tail)’। এই লেজ দুটো ২০ মিলিয়ন মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে (ছবিতে দ্রষ্টব্য)।
এখন একটা ধূমকেতু যখন তার এই দুটো লেজ নিয়ে সূর্যের চারপাশে দৌড়াতে থাকে, তখন সূর্যের আলোতে লেজগুলো কখন, কোনদিকে, কীভাবে বেঁকে যায়- সেটা চলুন নীচের ছবিতে দেখি।
দেখতেই পাচ্ছেন, সূর্যের চারপাশে পরিক্রমণের সময় লেজগুলো আমাদের সাধারণ জ্ঞানমতে ধূমকেতুর গতিপথের উল্টো পাশে বিস্তৃত ছিলো। কিন্তু একপর্যায়ে দেখা গেলো আমাদের সাধারণ যুক্তিকে কাঁচকলা দেখিয়ে ধূমকেতু যেদিকে ছুটছে তার লেজও সেদিকে বেঁকে গেছে! অর্থাৎ লেজের উল্টো পাশেই যে ধূমকেতু ছুটে, এটা সবসময় সঠিক নয়। অনেকসময় লেজ যেদিকে থাকে ধূমকেতুও সেদিকেই ছুটে চলে!
৪। পাঠ্যপুস্তকের ছবিতে আমাদের সৌরজগতের উপস্থাপন
আমরা যখন বিভিন্ন বইয়ে আমাদের সৌরজগতের উপস্থাপন দেখি চিত্রাকারে, সেটা তখন অনেকটা এরকম দেখায়-
প্রশ্ন হলো- এখানে ভুল কোথায়? সব গ্রহ-নক্ষত্র তো সঠিক অবস্থানেই আছে। উত্তর হচ্ছে- পুরোটাতেই ভুল! প্রথমত ধরি একেকটা গ্রহের আকারের উপস্থাপনে। উপরের ছবি হতে ধারণা পাওয়া স্বাভাবিক- বৃহস্পতি হচ্ছে পৃথিবীর আকারের মাত্র দেড়গুণ। কিন্তু বাস্তবে আমাদের সৌরজগতের অন্যান্য সদস্যের সামনে পৃথিবীর প্রকৃত আকার হচ্ছে মোটামুটি নীচের ছবিটার মতো।
পৃথিবীকে এই গ্রুপ সেলফিতে দেখতে পাচ্ছেন কি? খুঁজে না পেলে খেয়াল করুন নীলচে-সবুজ গ্রহটার দিকে, যেটাকে ধরা হচ্ছে ‘নেপচুন’ বলে। সেই নেপচুনের পায়ের কাছে অতি ক্ষুদ্র একটা বিন্দু দেখা যাচ্ছে কি? ওটাই আমাদের পৃথিবী! কথা হলো- এই স্কেলে আঁকতে গেলে পাঠ্যবইয়ের ছবিতে আমাদের পৃথিবীকেই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই সরলীকরণ করতে গিয়ে আমরা বাধ্য হয়েই ভুল আকারে উপস্থাপনাকে বেছে নিয়েছি।
দ্বিতীয়ত ধরি গ্রহগুলোর কক্ষপথের আকৃতি। সৌরজগতের মডেলের চিত্র হতে দেখতেই পাচ্ছেন সব গ্রহের কক্ষপথগুলো বৃত্তাকার। সেইসাথে সকল কক্ষপথ একই সমতলে অবস্থিত। কিন্তু বাস্তব অবস্থা নীচের ছবিটার মত।
গ্রহরা মূলত সামান্য উপবৃত্তাকার পথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। জ্যোতির্বিজ্ঞানী কেপলার গ্রহের গতিসংক্রান্ত তিনটি সূত্র প্রদান করেছেন। এর মধ্যে প্রথম সূত্র অনুযায়ী, গ্রহের কক্ষপথ হচ্ছে একটি উপবৃত্ত এবং সূর্য সেই উপবৃত্তের দুই ফোকাস বিন্দুর যে কোনো একটাতে অবস্থান করে। অর্থাৎ নীচের ছবির উপবৃত্তাকার কক্ষপথের হয় F1 না হয় F2 বিন্দুতে সূর্য সবসময় অবস্থান করবে। আবার একটা গ্রহের উপবৃত্তাকার কক্ষপথ যে আরেকটা গ্রহের কক্ষপথের সাথে সমান তলে থাকবে সেটারও কোনো গ্যারান্টি নেই।
এতসব গোলকধাঁধায় পড়ে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়িয়েছে ‘সেডনা’ নামক গ্রহের। অনেকেই হয়তো জানেন না সেডনা আমাদের সৌরজগতেরই আরেকটা গ্রহ। একে ‘মাইনর প্ল্যানেট’ ক্যাটাগরিতে রাখা হয়। এর কক্ষপথ এত বিশাল যে পুরোটা একবার পাক খেতে এর সময় লাগে পৃথিবীর সময়ের ১১,৪০০ বছর! সূর্যের সবচেয়ে কাছাকাছি যখন থাকে, তখন সেডনার সাথে সূর্যের দূরত্ব দাঁড়ায় ৭৬ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট। সেই দূরত্ব আসলে কতটুকু? দেখুন নীচের ছবিতে। উপরের বামদিকের ছবি হতে ঘড়ির কাঁটার দিকে অগ্রসর হোন। দেখবেন ‘জুম আউট’ করতে করতে আমাদের সূর্যের সাপেক্ষে সেডনার কক্ষপথের বিস্তার দেখানো হয়েছে।
সুসংবাদ হচ্ছে দীর্ঘ ১১,৪০০ বছরের উপবৃত্তাকার ভ্রমণপথে সেডনা এখন সূর্যের কাছাকাছি চলে আসার পর্যায়ে আছে। দুঃসংবাদ হচ্ছে এই আর্টিকেলের অধিকাংশ পাঠকই সেই ঘটনা দেখার জন্যে বেঁচে থাকবেন না। যদি দীর্ঘায়ু পেয়ে থাকেন তবে কপাল খুললেও খুলে যেতে পারে। কারণ ঘটনাটা ঘটবে ২০৭৬ সালে। ২০৭৬ সালের পর আবার সেডনা ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকবে ১১,৪০০ বছরের আরেকটা ‘খ্যাপ’ মারার জন্যে। এরপরে যখন আবার সে ফিরবে তখন হয়তো মানবসভ্যতাই থাকবে না। আর থাকলেও হয়তো তারা তখন ব্যস্ত থাকবে মহান বিজ্ঞানী ‘ইউডারন’ এর বিবর্তনবাদ তত্ত্ব নিয়ে চুল ছেঁড়াছেঁড়িতে, কারণ সেখানে দাবী করা হয়েছে- বর্তমান সভ্যতা নাকী Homo Sapiens নামক এক নিম্ন-বুদ্ধিসম্পন্ন, হিংস্র, জংলী প্রাণীদের থেকে উদ্ভূত হয়েছে। কী সব বোকার মত কথাবার্তা!
৩। গ্রহরা সবসময় একটা নির্দিষ্ট গতিতে ছুটে
আগের পয়েন্টেই দেখেছেন, গ্রহরা বৃত্তাকার পথে ঘোরে না। বরং তারা ঘোরে উপবৃত্তাকার পথে। এই উপবৃত্তাকার পথে ঘোরার কারণেই আরেকটা ব্যাপার ঘটে। সেটা হলো- গ্রহদের গতিবেগ ধ্রুব নয়। যখন আমরা বলি যে পৃথিবীর গতি ঘণ্টায় ১,০৭,২০০ কিলোমিটার, তখন আমরা মূলত তার গড় গতিবেগকেই বুঝাই। কিন্তু কোনো এক মূহুর্তে পৃথিবীর বেগ এর কম বা বেশীও হতে পারে। এর কারণ পৃথিবীর উপবৃত্তাকার কক্ষপথ। সেটা কীভাবে?
ব্যাপারটা বুঝতে হলে তাকান কেপলারের গ্রহ সংক্রান্ত তিনটি সূত্রের দ্বিতীয়টায়। সূত্রটা এখানে উল্লেখ করলে অনেকেই এই আর্টিকেলের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ব্রাউজারের পাশের ট্যাবে খোলা ‘ট্রল’ পেইজে চলে যাবেন অনন্ত জলিলের ছবিবিশিষ্ট ট্রল পোস্টে লাইক আর কমেন্ট করতে। তাই সূত্রটা নিজ দায়িত্বে অন্য কোথাও হতে পড়ুন। এখানে শুধু ব্যাখ্যাটা দিচ্ছি। নীচের ছবিতে তাকান।
আগেই বলেছি F1 কিংবা F2 অবস্থানে থাকবে সূর্য। এর চারপাশে যে উপবৃত্তাকার কক্ষপথ থাকবে সেখান থেকে দুইটা বিন্দু নেই A এবং B. আবার সেই একই কক্ষপথে আরো দুটা বিন্দু নেই A’ এবং B’. এখন যদি ABF1 এবং A’B’F1 এর ক্ষেত্রফল একই হয়, তাহলে আমাদের কেপলার নানা সংসদের ‘পয়েন্ট অব অর্ডারে’ দাঁড়িয়ে টেবিল চাপড়ে জোর গলায় দাবী করছেন- গ্রহটার AB এবং A’B’ দূরত্বটুকু অতিক্রম করতে একই সময় লাগবে। কিন্তু ছবিতে তো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে AB এর দূরত্ব বেশী, A’B’ এর দূরত্ব কম। মজাটা এখানেই! গ্রহটা AB দূরত্ব যত দ্রুত অতিক্রম করবে, A’B’ দূরত্ব তার চেয়েও আস্তে অতিক্রম করবে। ফলে দুইক্ষেত্রেই অতিক্রান্ত সময় সমান থাকবে।
মোদ্দা কথা হলো, যখনই গ্রহ সূর্যের কাছাকাছি আসতে থাকবে, তার গতিবেগ বাড়তে থাকবে। এক পর্যায়ে সে লোকাল বাসের ড্রাইভারের মত তীব্র বেগে সাঁই করে সূর্য হতে ক্ষুদ্রতর দূরত্বটা অতিক্রম করে যাবে। এই দূরত্ব অতিক্রম করে দূরে সরে যেতে যেতে তার গতি আবার ধীর হয়ে যাবে। সবচেয়ে ধীর হয়ে পড়বে নক্ষত্র হতে সর্বাপেক্ষা বেশী দূরত্বে অবস্থানকালে। তারপর আবার তার গতি বাড়তে থাকবে।
তবে কথা হলো, যেভাবে উপস্থাপন করলাম সেভাবে গতি এত বেশী বাড়ে বা কমে না। গড় গতির থেকে কিছু হ্রাস-বৃদ্ধি হয় এই যা। কিন্তু সেটাও হেলাফেলা করার মত কোনো পরিমাণ নয়। আর এই গতির সাথে আহ্নিক গতির (যেটার কারণে দিন-রাত হয়) কোনো সম্পর্ক নেই। এটা শুধুই বার্ষিক গতির জন্যে প্রযোজ্য।
আহ্নিক গতির কথা যখন আসলোই…………
২। দিন থেকে মাস আর মাস থেকে বছর গড়ায়
আমরা জানি আহ্নিক গতির কারণে দিন-রাত হয়। অর্থাৎ গ্রহ নিজ অক্ষের উপরে লাটিমের মত ঘুরতে থাকলে দিন পেরিয়ে রাত, আর রাত পেরিয়ে দিন হয়। এদিকে বার্ষিক গতির কারণে, অর্থাৎ পুরো উপবৃত্তাকার কক্ষপথে গ্রহের পাক খেতে থাকার কারণে বছর গড়ায়। এখন বলুন তো আমাদের সৌরজগতের কোন গ্রহে দিন সবচেয়ে ছোট? কোনটায় দিন সবচেয়ে বড়?
সাধারণ যুক্তি বলবে- যে গ্রহটা ছোট, সেটায় দিন-রাতও ছোট। কারণ সেটা কম পরিধির কারণে ঘুরতেও কম সময় লাগে। আর যে গ্রহটা বড় সেটায় দিন রাতও বড়। সেই হিসেবে বুধ গ্রহে দিন ছোট হবার কথা। আর সবচেয়ে বড় হবার কথা বৃহস্পতিতে। কিন্তু আগেই বলেছি, মহাশূন্য আমাদের সাধারণ যুক্তির ধার ধারে না। সে সবসময় আমাদের যুক্তিকে মধ্যাঙ্গুলী প্রদর্শন করতে ভালোবাসে।
সত্যিটা হলো- আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতির একটা দিন হচ্ছে পৃথিবীর ৯.৯ ঘণ্টার সমান। যদি বৃহস্পতি গ্রহে সূর্য উঠার সাথে সাথে আপনি ‘লর্ড অব দ্যা রিংস’ মুভিগুলো দেখা শুরু করেন, তবুও সূর্যাস্ত হবার আগে আগে পুরো ট্রিলজি আপনি দেখে শেষ করতে পারবেন না! ‘গ্যানডালফ’ এর কপালে শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছিলো সেটা জানার আগেই সূর্য অস্ত যাবে।
এদিকে গ্রামীণ প্রবাদে বলা হয়, “বাঁশের থেকে কঞ্চি মোটা”। পৃথিবীর প্রতিবেশী শুক্রের অবস্থা হচ্ছে তাই। শুক্র গ্রহের একদিন হচ্ছে ২৪৩টা পৃথিবীর দিনের সমান। কিন্তু শুক্র ২২৪.৭ পৃথিবী দিনের সময়ে সূর্যের কক্ষপথে তার পরিভ্রমণ শেষ করে। সোজা বাংলায়-
১ শুক্র বছর = ২২৪.৭ পৃথিবী দিন
১ শুক্র দিন = ২৪৩ পৃথিবী দিন
অর্থাৎ, কোনো এক সকালে শুক্র গ্রহে সূর্যোদয় হবার পরে সেই সূর্য আবার ডোবার আগে বছরই শেষ হয়ে যাবে!
আসলে কোন গ্রহ কত গতিতে পাক খাবে সেটা নির্দিষ্ট হয়ে যায় তাদের জন্মলগ্নেই, যখন সবে গ্যাস এবং অন্যান্য পদার্থের কুণ্ডলী হতে সবে সূর্যটা তৈরি হচ্ছে। এই সময় পুরো সৌরজগতটা একটা ডিস্কের মত চ্যাপ্টা থাকে।
সেই তীব্র ঘূর্ণায়মান ডিস্কের মেঘমালা হতে পদার্থ জমাট বেঁধে শিশু গ্রহ তৈরি হয়। এদের বলে প্রোটো-প্ল্যানেট। এরা ডিস্কের গতির সমানে সমানেই ঘুরতে থাকে। কিন্তু পরে যতই একেকটা গ্রহে পদার্থ জমতে থাকে, ততই তাদের ঘূর্ণনগতি বাড়তে কিংবা কমতে থাকে। এক পর্যায়ে যখন তারা একটা নিরাপদ কক্ষপথে তাদের আবাস খুঁজে নেয়, তখন থেকেই তাদের আহ্নিক গতি নির্দিষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং কোনো গ্রহের আহ্নিক গতির সাথে তার আকারের কোনো সম্পর্ক নেই।
১। প্লুটো (কিংবা কুইপার বেল্ট) এর পরেই আমাদের সৌরজগতের সীমানা শেষ
আমাদের সৌরজগতের সীমানা কোথায়? প্লুটোর পরেই, তাই না? নাকি কুইপার বেল্টের পরে? এর পরেতো আর কোনো কিছু আমাদের সৌরজগতের সীমানার মধ্যে পড়ে বলে মনে হয় না।
ভুল! আপনি মূল উত্তরের ধারে কাছেও পৌঁছাননি। “আমাদের সৌরজগতের সীমানা কোথায়” এটার উত্তর খুঁজার আগে আমাদের আরেকটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। সেটা হচ্ছে- “সূর্য আসলে কী?”
আপনার বিস্মিত জবাব, “একটা নক্ষত্র। আবার কী?”
আমাদের প্রশ্ন, “ নক্ষত্র আসলে কী?”
এই পর্যায়ে আপনি “ধুর” বলে সত্যি সত্যি পাশের ট্যাবে খোলা ট্রল পেইজে অনন্ত জলিলকে নিয়ে নতুন কী আপডেট দেয়া হয়েছে সেটা খোঁজ করতে যাবার উদ্যোগ নিচ্ছেন। কিন্তু যাবার আগে আর ৫টা মিনিট একটু সময় দিয়ে যান।
নক্ষত্ররা হচ্ছে একেকটা দানবাকৃতির পারমাণবিক চুল্লী যাদের ভেতরে অনবরত ফিউশন বিক্রিয়া ঘটে যাচ্ছে। এইসব পারমাণবিক বিক্রিয়ায় ঘটা হলিউড স্টাইলের একেকটা বিশাল বিশাল বিস্ফোরণের কারণে সৌর বায়ু ছড়িয়ে যাচ্ছে চারপাশে। এই সৌর-বায়ুতে চড়ে প্লাজমা এবং আরো ক্ষুদ্র সব কণারা সুপারসনিক গতিতে ভেসে যাচ্ছে মহাবিশ্বের অনেক দূর পর্যন্ত। এদের এভাবে সুপারসনিক গতিতে বয়ে যাবার একটা উদ্দেশ্য আছে। সেটা হচ্ছে আমাদের সোলার সিস্টেমের বাইরে, বহির্জাগতিক ক্ষেত্র হতে উড়ে আসা অন্যান্য সব নক্ষত্রের গ্যাস এবং ধূলিকণাকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া। সৌর-বায়ু ছড়িয়ে পড়ে একটা শক-ওয়েভের মাধ্যমে এইসব আন্তঃনাক্ষত্রিক ধূলিকণাকে ঝাড়ু দিয়ে বেড়াচ্ছে। এই শক-ওয়েভটাকে বলা হয় ‘বো শক (Bow Shock)’।
একটা পর্যায়ে গিয়ে সৌর-বায়ুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন শুরু হয় আরেকটা ধাপ। এই ধাপ শুরু হবার মুহূর্তটাকে বলা হয় ‘টার্মিনেশন শক (Termination Shock)’। ছবিতে দেখা গাড় নীল অংশটার সীমানায় হচ্ছে টার্মিনেশন শকের অবস্থান। ‘ভয়েজার-১’ হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এই সীমানা সূর্য হতে ৯৪ অ্যাস্ট্রোনমিক একক পরিমাণ দূরত্বে অবস্থিত। কিন্তু আগেই যেমন বলেছি- এখানেই আমাদের সূর্যের খেল খতম নয়। পরের ধাপের মাত্র শুরু। এই ধাপে সৌর-বায়ু দুর্বল হয়ে সুপারসনিক হতে সাবসনিক গতিতে ছুটে চলতে থাকে এবং আগের মতই বাইরের সব নক্ষত্র হতে উড়ে আসা ধূলিকণা এবং গ্যাসকে ঝাড়ু মেরে দৌড়াতে থাকে। এটাকে বলা হয় ‘হেলিওশিথ (Heliosheath)’। ছবির হালকা নীল অংশটা হেলিওশিথ মণ্ডল।
সবশেষে সৌর-বায়ু একটা সীমানায় গিয়ে থেমে যায়। সেখানে সৌর-বায়ু এবং বহির্জাগতিক কণার শক্তি সমান সমান। ফলে তারা কেউ কাউকে আর ঝাড়ু মেরে বিদায় না করে চুপচাপ দুজনে দুটা চেয়ারে বসে লুডু খেলতে থাকে। এই সীমানাটাকে বলা হয় ‘হেলিওপজ (Heliopause)’। আমাদের সৌরজগতের সীমানা এই পর্যন্ত। এবং এই দূরত্ব হচ্ছে সূর্য হতে প্লুটোর দূরত্বের তিনগুণ!
কিন্তু ছবিতে ‘হেলিওশিথ’ মণ্ডলটা এমন চ্যাপ্টা হয়ে গেছে কেন? এর কারণ হচ্ছে, আমাদের সূর্য তার চ্যালা-চামুণ্ডাদের (মানে আমরা আর অন্যান্য গ্রহ এবং ধূমকেতুরা) নিয়ে প্রচণ্ড বেগে সামনে ছুটে চলছে। প্রতি ঘণ্টায় সে ৪৫,০০০ মাইল বেগে ছুটে আমাদের নিয়ে চলছে ‘মিল্কি ওয়ে’ গ্যালাক্সির কেন্দ্রের দিকে। সেখানে অপেক্ষা করে আছে এক ব্ল্যাক হোল। গত ৪.৬ বিলিয়ন বছর ধরে সে তার সৌর-বায়ুর শক-ওয়েভ দিয়ে আমাদের সামনে চলার রাস্তা ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার করে দিচ্ছে, আর আমাদের হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যাতে শেষমেশ আমরা গিয়ে একটা ব্ল্যাক-হোলের মুখে পড়তে পারি! তবে তার আগেই সূর্যের আয়ু শেষ হয়ে যাবে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। এরকম ফাজলামো করার কী কারণ- সেটার কোনো জবাব আজ পর্যন্ত নেই। ভবিষ্যতেও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
(সমাপ্ত)