প্রয়াত লেখক শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আহমেদ স্যার বলেছিলেন, “বাচ্চারা সত্যি কথা বলে- এটা সবসময় ঠিক না। তারা সত্যি কথা বলে তখনই যখন কাউকে বিপদে ফেলতে হয়”। আর শ্রদ্ধেয় মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যারতো বাচ্চাকাচ্চারা কেন একেকটা ধাড়ি বদমাশ সেটা তাঁর ‘বাচ্চা ভয়ংকর কাচ্চা ভয়ংকর’ নামক এক বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণাপত্রে(!) বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। যারাই এই তথাকথিত তুলতুলে ‘আদরের পুটলি’দের পেছনের প্রকৃত চেহারাটা দেখেছেন তারাই একবাক্যে স্বীকার করবেন- এরা আসলে সব নিষ্পাপ চেহারার আড়ালে বিশাল ক্ষমতালোভী এবং ডাহা মিথ্যুক একেকটা সাইকোপ্যাথ।
দেখা গেছে, বিজ্ঞানীরাও আমাদের সেই সন্দেহের সাথে একমত। তারা বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন আপনার ডাহা মিথ্যা কথা বলা, জনগণের সম্পদ লোপাট করা, ঢং করা কিংবা সোশাল সাইটগুলোতে সুন্দর চেহারাওয়ালা মানুষদের অর্থহীন সব স্ট্যাটাসে লাইক দিয়ে তাদের মন পাওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা- এই সমস্ত বদঅভ্যাসের মূল সূত্রপাত আপনি যখন সদ্য মায়ের উদর হতে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন তখন থেকেই। বড় হওয়ার সাথে সাথে আপনি শুধুমাত্র সেইসব বদঅভ্যাসগুলোকে একেকটা শিল্পে রুপান্তরিত করেছেন, এই যা! এখানে আমরা তেমন কিছু উদাহরণ দেবো। বদঅভ্যাসের মাত্রা বাড়তে থাকবে, যতই আমরা পোস্টের নিচের দিকে যেতে থাকবো; এক-এ গিয়ে দেখবো, সবচেয়ে ভয়াবহ কাহিনী! আসুন, শুরু করি।
৬) মিথ্যা কথা বলা
আপনি জন্মসূত্রে হয়তো কথা বলার ক্ষমতা নিয়ে মায়ের পেট হতে আসেননি, সেটা আপনাকে জন্মের পর দুই-তিন বছর ধরে চর্চার মাধ্যমে আয়ত্ত্ব করে নিতে হয়েছে। কিন্তু মিথ্যা কথা বলার ক্ষমতা আপনার জন্মগত বৈশিষ্ট্য। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন– যখন আপনার বয়স ছিলো সবে পাঁচ কি ছয় মাস, তখন হতেই আপনি ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’ ব্যবহার করে, ‘মেকি কান্না’ কেঁদে কিংবা বাপ-মাকে তেল মেরে বশে রাখার জন্যে ‘মেকি হাসি’ হেসে সবাইকে বিভ্রান্ত করে আসছিলেন। মাঝেমধ্যেই দেখবেন এক বছরের কম বয়সী বাচ্চারা কখনো কখনো অযথা হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ কান্না থামিয়ে দুই-এক সেকেন্ডের জন্যে দেখে নেয় তাদের কান্নায় আশেপাশের পরিবেশে ঠিকমত প্রভাব পড়ছে কিনা। আমরা কেউ ব্যাপারটা সহজে খেয়াল করি না, কারণ তারা এই ‘কুমীরের কান্না’ করার কাজে জন্মগতভাবেই দক্ষ।
এর থেকেও ভয়াবহ ব্যাপার হলো বাচ্চারা কোন ভুল করে ফেলেছে টের পেলে সেটা ধামাচাপা দেয়ার জন্যেও কান্নাকাটি শুরু করে। সবার মনোযোগ আকর্ষণের জন্যে কান্নাকাটি করাটা খুব একটা দোষের নয়। নিজের প্রতি সবার ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার ব্যাপারটা বেশ আনন্দদায়কই। কিন্তু কান্নাকাটি করে সবার মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে দেয়াটা? এর মানেতো হলো সে নিশ্চয়ই কোন খারাপ কাজ করে ফেলেছে যেটা এখন সবার কাছ হতে লুকাতে চাইছে। অর্থাৎ আমরা যখন কারো সাহায্য ছাড়া টয়লেট করাটা পর্যন্ত শিখিনি, তখন হতেই আমরা ভুল কাজের পেছনে অজুহাত দাঁড়া করানোয় বিশেষজ্ঞ ছিলাম!
#কিন্তু কেন বাচ্চারা এমনটা করে?#
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে মিথ্যা বলাটা মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশের পক্ষে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা বৈশিষ্ট্য। ভাবছেন- সেটা কিভাবে? মিথ্যাই তো সামাজিক সব অসঙ্গতির ‘নাটের গুরু’।
তাহলে এর পর থেকে বাসায় নিজের বউকে বলে দেখুন “তুমি তো দিন দিন হাতির মত মোটা হয়ে যাচ্ছো”, কিংবা বন্ধুকে বলে দেখুন “তুই তো শালা একটা গবেট। দ্যাখ, আমি ‘অমুক’ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি, আর তুই ‘তমুক’ প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিস” – আর এরপর দেখুন আপনার সব সামাজিক সম্পর্কগুলো কোথায় গিয়ে ঠেকে (এই আর্টিকেলের লেখক নিজেই অবশ্য একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গর্বিত ব্যাচেলর ডিগ্রীধারী)। আর একটু বেশি সাহসী হলে আগামীকাল আপনার অফিসের বসকে গিয়ে বলুন, “স্যার, আপনার জায়গায় আমি হলে আরো ভালোভাবে অফিস চালাতে পারতাম”।
উপরের সবগুলো কথাই সত্যি, কিন্তু সেগুলো বলতে গেলেই ব্যাপক সামাজিক বিপর্যয় এবং অস্থিরতা নেমে আসবে। সবাই শতভাগ সত্যবাদী হয়ে গেলে মানবসভ্যতা এক মাসের মাথায় ধ্বংস হয়ে যাবে। এই কারণে, মানব সভ্যতার বিস্তার ধরে রাখার স্বার্থেই তাকে জন্মগতভাবে মিথ্যা কথা বলার ক্ষমতা দিয়ে পাঠানো হয়। তবে সেই সাথে এই তথ্যও তার চেতনায় দিয়ে দেয়া হয় যে- নির্দিষ্ট সীমার বাইরে এই ক্ষমতার ব্যবহার নিজের এবং আশেপাশের সবার ধ্বংস ডেকে আনবে।
অর্থাৎ বলা যায়, খারাপ পরিবেশ হতে (উদাহরণস্বরুপ- টিভির মেগাসিরিয়াল) আপনি আসলে মিথ্যা বলা শিখছেন না। বরং আপনার সেই জন্মগতভাবেই প্রাপ্ত মিথ্যা বলার ক্ষমতাকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করছেন মাত্র। সেটাকে আরো ঘষে-মেজে মসৃণ করছেন। মানুষ বড় হতে হতে আসলে মিথ্যা বলা শিখে না। তাকে বড় হবার সময় শিখতে হয় সত্য কথা বলাটা।
৫) শ্রেণীবৈষম্য
সুন্দর চেহারা দেখলেই আমরা সবাই পটে যাই। কিন্তু খুব কম মানুষই বাহ্যিক সৌন্দর্যের আড়ালে কারো প্রকৃত মেধা এবং আচার-আচরণকে যাচাই করি। কিন্তু শিশুরা তো আর এমন নয় তাই না? তাদের চোখে কালো মানুষই কি, আর ফর্সা মানুষই বা কি?
কথা ভুল! দেখা গেছে, অপরিচিত কিন্তু সুন্দর মানুষদের ফেইসবুক প্রোফাইল খুঁজে পেলেই তাদের হ্যাংলার মত সব জায়গায় ফলো করা, মেসেজ দিয়ে, পোক করে বিরক্ত করার মত বদঅভ্যাসগুলোর শিকড় আপনার জন্মের সময়ই ভেতরে বপন করে দেয়া হয়েছিলো। ডাক্তার আপনাকে মায়ের গর্ভ থেকে টেনে বের করার সময় হতেই আপনি মূলত আশেপাশে সুন্দর এবং আকর্ষণীয় সব মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন!
২০০৪ সালের এক গবেষণায় কয়েকটা বাচ্চাকে কিছু মানুষের ফটো দেখানো হয়েছিলো। সবগুলো ফটোই তাদের চোখের সামনে সমপরিমাণ সময় ধরে দেখানো হয়েছিলো। দেখা গেলো প্রচলিত অর্থে “আকর্ষণীয়” চেহারার মানুষদের ছবি বাচ্চারা বেশিসময় ধরে দেখছিলো, আর সাধারণ চেহারার মানুষদের ছবিগুলো একটু দেখে নিয়েই আবার চোখ ফিরিয়ে হাত কামড়ানো কিংবা পা টেনে ধরে মুখের কাছে নিয়ে আসার মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে তারা ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলো। এদের মধ্যে প্রায় সবার বয়সই ছিলো মাত্র সাত দিন বা এর কিছু কম বেশি!
ঘটনা এইখানেই থামলে ভালো ছিলো; কিন্তু হায়! বয়স সাতদিন হতে এক মাস গড়াতে না গড়াতেই দেখা গেলো – বাচ্চাগুলো তাদের জাত চিনে ফেলেছে। অর্থাৎ তখন তারা শুধু সুন্দর মানুষের ফটো দেখলেই আকৃষ্ট হয়ে পড়তো না। সেই সুন্দর মানুষটা যদি একইসাথে তার জাতের সদস্য হয় তাহলেই শুধু তার ফটোর দিকে লক্ষ্য করতো। অর্থাৎ আপনি যদি এক মাসের একটা আমেরিকান বাচ্চাকে জাপানিজ কিংবা চাইনিজ সুপারমডেলের ছবি দেখান তাতেও কাজ হবেনা। তাকে আমেরিকান মডেলদের ফটো দেখালেই সে খানিক্ষণের জন্যে মনোযোগ দিয়ে তাকাবে! তাদের মতে- চাইনিজ, জাপানিজ, কোরিয়ান সব একই কথা!
সোজা ভাষায় বলতে গেলে, বাচ্চারা সবসময় আভ্যন্তরীণ গুণাবলী হতে বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয় (যেটা বয়স হবার পরেও অনেকে কাটিয়ে উঠতে পারে না)। কিন্তু তারা কখনো ‘সৌন্দর্য’ এবং ‘জাত’ নিয়ে দ্বিধার সম্মুখীন হলে আগে জাতটাকে প্রাধান্য দিবে, তারপর সৌন্দর্য নিয়ে মাথা ঘামাবে। আর এই সৌন্দর্য, শ্রেণী, এবং জাত সম্পর্কিত ধারণা তাদের ভেতরে গড়ে উঠতে শুরু করে মাত্র সাতদিন বয়স হতেই।
#কিন্তু কেন বাচ্চারা এমনটা করে?#
বেঁচে থাকার তাগিদে! ‘সারভাইভাল ইন্সটিংক্ট’। আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, একটা সাতদিন কিংবা একমাসের বাচ্চাও মনে মনে বিশ্বাস করে সুন্দর মানুষেরা নিখুঁত ব্যক্তিত্ত্বের অধিকারী হয়। তাদের জিনগুলো হয় নিখুঁত। তাদের সামাজিক এবং প্রাকৃতিক বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন কম হওয়া লাগে। এর ফলে বাচ্চারা চায় তাদের নিরাপত্তায় থাকতে। অথচ ধারণাগুলো সম্পূর্ণ ভ্রান্ত।
ফলে জন্মের পরপরই বাচ্চারা চোখ বড় বড় করে যেসব জিনিস দেখে তার মধ্যে একটা হলো রুমে তার আশেপাশে কোন সুপারমডেল জাতীয় কেউ আছে কিনা। থাকলে ধরে নেয় সেই তার ‘মা’। কিন্তু সত্য ঘটনা উপলব্ধি করতে পারলেও সমস্যা নেই। নির্দোষ চোখের বড় বড় চাহনি দিয়ে হলেও বাচ্চারা চেষ্টা করে সেই মানুষটাকে আকৃষ্ট করতে যাতে সে আবেগে গলে গিয়ে তাকে দত্তক হিসেবে নিয়ে নেয়। এটা আসলে তার ‘সারভাইভাল ইন্সটিংক্ট’ এরই অংশ। সে ধরেই নেয় নিজের জাতের সুন্দর চেহারা এবং স্বাস্থ্যবান মানুষের কাছে সে ভালো থাকবে।
অর্থাৎ, বড় হবার সময় শ্রেণীবৈষম্য আপনি আশেপাশের পরিবেশ হতে শেখেন না। সেটাকে আরেকটু ঝালাই করে নেন, এই আর কী! বরং শ্রেণীবিভেদ ও বর্ণবাদহীন মুক্ত মনের মানুষ হওয়াটাই আপনাকে বড় হতে হতে শিখে নিতে হয়।
৪) মাতলামি করা
ধরুন, আপনার সদ্য বসতে শেখা বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামিয়ে তার বিছানায় রাখলেন। সে কিছুক্ষণ শুয়ে শুয়ে খেললো। তারপর হঠাৎ দেখলেন সে উঠে বসে তার খাটের সীমানার শিকগুলো ধরে প্রচণ্ডভাবে তাতে মাথা ঠুকতে শুরু করেছে। আপনি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলেন, কী করবেন ভেবে পেলেন না! তখন এক পর্যায়ে দেখলেন বাচ্চাটা মাথা ঠোকা বন্ধ করে আস্তে করে শুয়ে পড়লো এবং খানিকবাদে ঘুমিয়ে গেলো।
কী ঘটলো এখানে? সেটায় যাবার আগে বলে নেই, আপনার বাচ্চাটিই শুধু এমন করে না। আট-নয় মাস বয়সী অনেক বাচ্চাই এই কাজ করে থাকে। চোখে ঘুম ঘুম ভাব আসার পর তারা দেয়ালজাতীয় কোন কিছুতে প্রতি মিনিটে ৭০-৮০ বার মাথা ঠুকে থাকে। এইভাবে দুই-চার মিনিট চলার পর হঠাৎ ক্ষান্ত দিয়ে চুপচাপ শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
#কিন্তু কেন বাচ্চারা এমনটা করে?#
কারণ এটার অনুভূতি অসাধারণ! চোখে ঘুম ঘুম ভাব নেমে আসার পর প্রচণ্ডভাবে মাথা ঝাঁকানোর সময়কার অনুভূতির তুলনা হতে পারে একমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের এলকোহল পান করার সাথে। এই কাজ করার ফলে বাচ্চাদের রক্তে এক বিপুল পরিমাণ এড্রেনালিন হরমোন নিঃসরিত হয় যেটা তাদের ভেতরে একটা ঘোরলাগা ভাব সৃষ্টি করে। এই ঘোরলাগা ভাব তৈরি করতে সে আপনার চোখ রাঙ্গানো কিংবা বকুনিরও তোয়াক্কা করে না। সে শুধু চায় এড্রেনালিন তার সারা শরীরের রক্তে ছড়িয়ে পড়ুক। সেটার প্রভাবে সে ঘুমের মাঝে একটু পরেই হারিয়ে যাবে মেঘপরীদের দেশে!
অর্থাৎ মানুষ জন্মগতভাবেই ড্রাগ এডিক্টেড। বড় হবার সময় শুধু চর্চা করতে হয় এইসব ড্রাগ হতে নিজেদের মুক্ত করার জন্যে।
৩) অবাধ্যতা
আমরা বড়রা বাচ্চাদের নিয়ে অনেকসময় একটা মজার খেলা খেলি। সেটা হলো দুই হাত বাড়িয়ে “আসো তো সোনা, আমার কোলে আসো, চকলেট দিবো-চিপস দিবো” বলে বলে তাকে নিজের কোলে নেয়ার জন্যে আকর্ষণ করি। তখন মাঝে মাঝে চকলেটের লোভে সে ঝাঁপ দিয়ে আপনার কোলে চলে আসে। আবার কখনো কখনো চকলেট-চিপসের মত অতি আরাধ্য বস্তুর আকর্ষণ উপেক্ষা করে পুরোপুরি উদাসীন থাকে। অতি মনোযোগ সহকারে হাতে ধরে রাখা ঝুনঝুনি কামড়াতে থাকে, যেন আপনার কথা সে শুনতেই পায়নি। তখন তার ভাব দেখলে মনে হয় সে কোন একটা দেশের প্রেসিডেন্ট এবং যদি ক্ষমতা থাকতো তবে সে আপনাকে হাতের মধ্যাঙ্গুলি প্রদর্শন করতো।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাচ্চারা প্রথম আধো আধো বোলে যে শব্দটা বলতে শিখে সেটা হচ্ছে ‘না’। শব্দটা আবার ভালো করে পড়ুন। শব্দটা ‘মা’ নয়, শব্দটা হচ্ছে ‘না’! অর্থাৎ তাদের যখনও শরীরের সাইজ এমন থাকে যে দুই আঙ্গুলের মাঝে ধরে তাদের পিষে চ্যাপ্টা করে ফেলা যায়, তখন হতেই তারা ঘাড়ত্যাড়ামো করতে শিখে যায়।
#কিন্তু কেন বাচ্চারা এমনটা করে?#
এটা করার মানে হচ্ছে বাচ্চারা ধীরে ধীরে নিজেদের চিনতে শিখছে। তাদের ভেতরে ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠছে। তারা তাদের নিজস্ব মতামত এবং চিন্তাধারা প্রকাশ করতে শিখছে। তারা এইসময় সবাইকে বুঝাতে চায় তারা সবার হাতের খেলার পুতুল নয়। “Their lives, their rulezzzz”. এই কারণে দরকার হলে তারা চকলেট-চিপসের মত বস্তুও বিসর্জন দিতে রাজি!
মনে আছে, আপনি যখন প্রথম জন্মেছিলেন তখন আপনাকে ঘুমের সময় বিছানায় শুইয়ে দিলেই আপনি ঘুমিয়ে যেতেন (মনে না থাকলেও লজ্জা পাবার কিছু নেই, আমাদেরও মনে নেই)। কিন্তু মাসকয়েক পরে হঠাৎ আপনার খেয়াল হলো, “যদি আমার এখন না ঘুমিয়ে খেলতে মন চায়, তাহলে কী হবে? কী হবে যদি কেউ এখন আমাকে খেলতে বাধা দিয়ে ঘুম পাড়াতে আসে, আর আমি ঘুসি মেরে তার নাক ফাটিয়ে দিই?” এই প্রশ্নগুলো প্রথম মাথায় আসার পর হতেই মূলত আপনার ব্যক্তিত্ত্ব বিকাশের শুরু। আর সেটা ঘটে জন্মের মাত্র দুই কি তিন মাস পর থেকেই।
শিশুরা মূলত বয়স্কদের চেয়েও অত্যন্ত আত্মসচেতন এবং আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন হয়। পরে যখন সে বড় হতে থাকে তখন মূলত সে বাস্তবতা এবং পারিপার্শ্বিকতার চাপে মাথা নোয়ানো শিখতে শুরু করে। সুতরাং বলা যায়, আত্মসম্মানবোধ বড় হতে হতে শিখতে হয় না। বরং বাস্তবতার স্টীমরোলারে চাপা পড়ে আপনি যাতে এই জন্মগতভাবে প্রাপ্ত গুণটা হারিয়ে না ফেলেন- সেটাই শুধু খেয়াল রাখতে হয়।
২) ব্ল্যাকমেইলিং
ধরুন, আপনি একটা দামী মোবাইল সেট কিনলেন। কিন্তু সেটা আপনার ছোট ভাই কিংবা বোনের নজরে পড়ে গেলো। যেহেতু মোবাইলটা আপনি কিনেছেন বিধায় এটার মালিক আপনি, সেহেতু সে কিছুই বলতে পারছে না। কিন্তু মোবাইলটা তার খুব পেতে ইচ্ছে করছে। তখন সে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিং করতে শুরু করলো। এমনভাবে চোখেমুখে করুণ ভাব ধরা শুরু করলো যে আপনি নিজে অপরাধবোধে আক্রান্ত হয়ে গেলেন। তার জন্যে খারাপ লাগা শুরু করলো। তখন আর না পেরে তাকে মোবাইল সেটটা দিয়ে দিলেন।
দেখা গেছে, এই ব্ল্যাকমেইলিং মানুষ জন্মের মাস পাঁচেক পর হতেই শুরু করে। তবে সেটা আরো ভয়ংকর আকারে। যদি বাচ্চাদের চোখে একটা কিছু ধরা পড়ে যায় তাহলেই সেরেছে। সেটা না পাওয়া পর্যন্ত তারা চিৎকার-চেঁচামেচি, কান্নাকাটি হতে শুরু করে আরো ভয়ংকর কিছু ঘটাবে। যেমন- নিজের হাত কামড়াতে থাকা, দেয়ালে মাথা ঠোকা, দম আটকে ধরে রাখা যে পর্যন্ত না সে অক্সিজেনের অভাবে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
বাচ্চারা শুধু ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিংই করে- তা নয়, বরং তারা প্রয়োজনে আত্মঘাতী হয়ে উঠতেও দ্বিধা করে না! বলাই বাহুল্য, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তে যাবার প্রয়োজন হয় না। তার আগেই কাজ হয়ে যায়। প্রথমবার দেয়ালে মাথা ঠোকার পর দ্বিতীয়বার ঠুকতে যাবার আগেই বাবা-মা তার দাবীকৃত সেই রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি কিনে এনে তার সামনে উপস্থিত করে। সাথে হয়তো জরিমানা হিসেবে থাকে চকলেট বক্স।
#কিন্তু কেন বাচ্চারা এমনটা করে?#
শিশুদের মাঝে অন্তত তিন-চার বছর বয়স হবার আগ পর্যন্ত ‘অন্যের মালিকানা’ বা ‘অন্যের কর্তৃত্ব’ সম্পর্কিত ধারণা ভালোভাবে জন্মায় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ‘নিজ মালিকানা’ সম্পর্কিত ধারণা মাত্র সাত-আট মাস বয়স হতেই গজাতে শুরু করে। ফলে দেখা যায় তারা মনে করে সবকিছুর মালিক আসলে সে, শুধু যখন যেটা প্রয়োজন সেটা টেনে হাতের কাছে নিয়ে নিলেই চলবে। এই কারণে যখন কেউ তার হাত থেকে কোনো বস্তু নিয়ে যায় যেটার মালিক সে নয় কিংবা কোন জিনিস বাবা-মায়ের কাছে চেয়েও পায় না, তখন তার মনে প্রশ্ন জাগে, “যেহেতু খেলনাটার মালিক আমি, সেহেতু কেন আমি খেলনাটা পাবো না?” আর তখনই নিজের খেলনাটা না পাবার দুঃখে, ক্ষোভে এবং অভিমানে সে যাচ্ছেতাই আচরণ করতে শুরু করে।
যদি হাত কামড়ে কিংবা দেয়ালে মাথা ঠুকে নিজের মালিকানাধীন(!) বস্তুটাকে ফিরে পাওয়া যায় তবে ক্ষতি কী?
১) খুন করা
বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরেই সন্দেহ করে আসছিলেন যে বাঁহাতি মানুষেরা মায়ের পেটে তাদের জীবন শুরু করেছিলেন যমজ বাচ্চা হিসেবে। এই ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি ছিলো- যমজ বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই সাধারণত দেখা যায় একজন ডানহাতি এবং আরেকজন বাঁহাতি হয়ে থাকে। কিন্তু যারা বাঁহাতি অথচ যমজ নন তাদের ক্ষেত্রে?
তাদের ক্ষেত্রে জেনেটিক বৈশিষ্ট্যসমূহ সবচেয়ে বড় নীতিনির্ধারক হয়ে থাকে। অর্থাৎ তাদের পরিবারে হয়তো আরো বাঁহাতি কেউ আছেন। কিন্তু, যদি তাও না থাকে তাহলে?
আপনি যদি সেই শেষোক্ত শ্রেণীতে পড়ে থাকেন (অর্থাৎ পরিবারে কোনো বাঁহাতি নেই, আবার আপনি যমজও নন) তাহলে বলা যায় আপনি আপনার জীবনের একটা অন্ধকার অধ্যায় সম্পর্কে অবগত নন। আপনি মায়ের পেটে থাকাকালীন সেখানে আরো একজন ছিলো আপনার সাথে। সে ছিলো আপনার যমজ ভাই কিংবা বোন। একইসাথে আপনাদের দুইজনের জন্ম হয়েছিলো। কিন্তু পরে একটা ‘খাঁচাবন্দী অবস্থায় ডুয়েল’ লড়ে আপনি তাকে খুন করে একাই নিজে দুনিয়াতে চলে এসেছেন!
বিজ্ঞানীদের এই সন্দেহ পরে সত্যি প্রমাণিত হয়, যখন আলট্রাসাউন্ড আবিষ্কৃত হয়। এটা বর্তমানে ‘ভ্যানিশিং টুইন‘ তত্ত্ব নামে পরিচিত। গবেষণায় আরো দেখা গেছে, গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি আটজনের একজন মূলত যমজ হিসেবে মায়ের পেটে তাদের জীবন শুরু করেন। কিন্তু এদের মধ্যে আসলেই যমজ হিসেবে দুনিয়াতে আসেন প্রতি ৭০ জনের একজন।
তাহলে বাকি যমজরা কোথায় যায়? বাকি যমজদের মধ্যে যে বাঁহাতি সে তার জোড়াটাকে মেরে ঐখানেই গেঁড়ে রেখে দুনিয়াতে চলে আসে!
#কিন্তু কেন বাচ্চারা এমনটা করে?#
‘সারভাইভাল অব দ্যা ফিটেস্ট’। মায়ের পেটে যমজ ভ্রুণ হিসেবে থাকার সময় সেখানে একটা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। দেখা যায়, একটা ভ্রুণ আরেকটার চেয়ে একটু বেশি দ্রুত বেড়ে উঠছে। সে ভ্রুণটাই মায়ের প্লাসেন্টা হতে সব পুষ্টি টেনে নিচ্ছে। বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে যখন স্থান সংকুলান হয় না, তখন সাথের জোড়াটাকে বাসা থেকে ‘কিক আউট’ করে তার সব মাংস এবং পুষ্টি নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে নিয়ে সেই জায়গা দখল করে নেয়।
এই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে কাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশি? ওপরের গল্প যদি সামান্য মনযোগ দিয়েও পড়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন – অবশ্যই বাঁহাতিদের! সুতরাং বাঁহাতিদের (যাদের বংশে আর তেমন কোন বাঁহাতি নেই) নিজের সহোদরকে মারার জন্যে একটু খারাপ লাগলেও অন্তত এই ভেবে গর্ব অনুভব করুন যে ‘সারভাইভাল অব দ্যা ফিটেস্ট’ এর ডুয়েলে আপনি ডানহাতিদের চেয়ে সবসময়ই বেশি শক্তিশালী। বাঁহাতি হবার কারণে যদি অন্য কেউ আপনাকে খোঁটা দেয়, তাতে নিজেকে ছোটো মনে করার কিছু নেই।
সবাই ভালো থাকবেন!