অলৌকিক ঘটনাবলী এবং তাদের বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যাসমূহ – প্রথম পর্ব

 ভূতুড়ে এবং অতিপ্রাকৃত কাহিনী শুনতে আমরা কে না পছন্দ করি? ছোটবেলায় মা, দাদী, নানীদের মুখে শোনা মেছোভূত, শাঁকচুন্নি, রাক্ষসীদের গল্প দিয়ে আমাদের অতিপ্রাকৃত জগতের রহস্যময়তায় বিচরণ শুরু। আরেকটু বড় হলে রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার, অশরীরি প্রেতাত্মা, জিন্দালাশ ইত্যাদি বিষয়ক বই পড়ে গা ছমছমে ভাব নিয়ে রাতে বিছানায় শুতে যাওয়া (অবশ্যই রুমের লাইট জ্বালিয়ে রেখে)! এসব স্মৃতিতো সহজে ভুলবার নয়। তবে আমাদের মাঝে অনেকেই আছেন একটু বেশি ভাগ্যবান (সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য সে বলতে পারবো না), যারা এইসব ভূতুড়ে কিংবা অতিপ্রাকৃত ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী। তাদের চাক্ষুষ প্রমাণের কারণে অন্যান্যরা জ্বিনে ধরা কিংবা অশরীরি দেখার মত অলৌকিক ব্যাপারসমূহকে সহজে ‘ফুঁহ’ বলে উড়িয়ে দিতে পারে না।

কথা হচ্ছে, যারা দাবি করেন নিজের চোখে ভূত-প্রেত দেখেছেন তাদের মধ্যে সবাই না হলেও কেউ কেউ আসলেই সত্যি কথা বলছেন। তবে এক্ষেত্রে তারা যেটাকে অশরীরি জাতীয় কিছু দেখার বা অনুভব করার দাবি করছেন সেগুলোর আসলে বৈজ্ঞানীক ব্যাখ্যা আছে। সত্যি কথা বলতে কি, এদের বৈজ্ঞানীক ব্যাখ্যাগুলো মূল অশরীরি দেখার কাহিনীর থেকেও বেশি চমকপ্রদ। যেমন-

১। ইডিওমোটর এফেক্ট (Ideomotor Effect)

ওইজা বোর্ড (Ouija Board)’ এর কথা আমরা অনেকেই শুনেছি। ওইজা বোর্ডের মাধ্যমে জীবিতরা মৃত মানুষদের আত্মাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। এর অস্তিত্ব বহু পুরনো হলেও মুলত ১৮৪০ কিংবা ১৮৫০ সালের দিকে এটা স্পিরিচুয়ালিস্টদের মাধ্যমে আধুনিক মানুষদের নিকট ব্যাপক পরিচিতি পেতে শুরু করে। ওইজা বোর্ডের মাধ্যমে মানুষজন তাদের প্রিয় মৃত মানুষদের সান্নিধ্য পেতে স্পিরিচুয়ালিস্টদের শরণাপন্ন হতে থাকে। এখন পর্‍যন্ত জনপ্রিয় এই বোর্ডের ধারণাটা খুবই সরল। বোর্ডে ইংরেজি বর্ণমালার অক্ষর, নাম্বার, এবং ‘হ্যাঁ-না’ জাতীয় উত্তরবিশিষ্ট কিছু শব্দ থাকবে। মানুষেরা একটা কাঠজাতীয় বস্তু, যেটাকে ‘প্ল্যানচেট’ নামে ডাকা হয়, সেটার উপর হাত রেখে অশরীরিদের ডাকবে। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে সেই অশরীরি আসার পরে তাকে জীবিত মানুষেরা কিছু প্রশ্ন করবে। সেই প্রেতাত্মা তখন প্রশ্নের জবাব দিবে ঐ প্ল্যানচেট নামক কাঠের বস্তুটাকে এক অক্ষর হতে আরেক অক্ষরে সরিয়ে নিয়ে নিয়ে বানান করে করে।

Mandatory Credit: Photo by Jon Santa Cruz / Rex Features (582062k) Ouija board with pointer VARIOUS - 2006

আরেকটা পদ্ধতি হচ্ছে ‘Table Tilting’ বা টেবিল ঝাঁকুনি পদ্ধতি। এতে কয়েকজন একটা টেবিলের উপর দুই হাত স্থাপন করবে। তারপর গভীর ধ্যানের মাধ্যমে তারা একজন মৃত ব্যক্তির আত্মাকে আসতে আমন্ত্রণ জানাবে। সেই মৃত আত্মা আসামাত্র টেবিল নিজে থেকেই ভয়ংকরভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠবে। কখনোবা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে এটা কিছু সময়ের জন্যে এক পায়ের উপর ভর করে বাকিটা মেঝে হতে শূণ্যে উঠে যাবে। পরিস্থিতি বেশি বেগতিক হলে এটা সারা রুমে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াবার মত দাবিও করা হয়েছে।

শুরু থেকেই অনেক প্রতারক এইসব ধাপ্পাবাজির সাথে জড়িত ছিলো। কিন্তু সবাই-ই কি ধাপ্পাবাজ?

এই প্রশ্নের জবাব পেতে আমাদের পাঠকদের নিয়ে যাচ্ছি সরাসরি বিজ্ঞানী ‘মাইকেল ফ্যারাডে’র কাছে। চমকে উঠলেন? না, প্ল্যানচেট করে জনাব ফ্যারাডের ভূতকে আমাদের পেইজে নামিয়ে আনা হয়নি! ইন্টারনেটে ভূতে আছর করা পেইজ দেখতে কেউই পছন্দ করে না! বরং আমরা এই ব্যাপারে তার জীবদ্দশায় করা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করছি। তিনি অতি বুদ্ধিমত্তার সাথে পরীক্ষার মাধ্যমে দেখিয়েছেন- টেবিলের এই নিয়ন্ত্রণহীন নড়াচড়ার মূল কারণ হচ্ছে আসলে ‘ইডিওমোটর প্রভাব’। এটা হচ্ছে সেই অবস্থা যখন ‘অটোসাজেশান’ ক্ষমতার প্রভাবে আমাদের অবচেতন মন বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ গ্রহণ করতে শুরু করে এবং সেই সাজেশান অনুযায়ী অবচেতন মন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নড়াচড়া করতে নির্দেশ দেয়। এই নড়াচড়া অবচেতন মনের নির্দেশে হয় বিধায় এটা পুরোপুরি অনৈচ্ছিক।

প্ল্যানচেট শুরুর আগেই লোকেরা ধরে নেয় টেবিল নড়াচড়া করবে। সেটা মনের অজান্তেই অটোসাজেশানের মত করে অবচেতন মনে পৌঁছে যায়। যখন অবচেতন মনের সাজেশানের ফলে এরকম চার-পাঁচজন মিলে পেশীর অনৈচ্ছিক নড়াচড়ার শিকার হয়, তখন সেই পাঁচজনের দশটা হাতের অনৈচ্ছিক নড়ন-চড়নে টেবিল যে উড়ে গিয়ে জানালা দিয়ে রুমের বাইরে পড়ে না এটাই বেশি! ১৮৫৩ সালের এক পরীক্ষায় দুই দল ভলান্টিয়ারদের একদলকে গোপনে বলা হয়েছিলো টেবিল বামদিকে নড়বে। আরেকদলকে বলা হয়েছিলো টেবিল ডানদিকে নড়বে। দুই দলকে একসাথে বসানোর পর ‘সেশন’ শুরু হবার অনেকক্ষণ বাদেও দেখা গেলো অশরীরির কোন পাত্তা নেই। টেবিল কোনদিকে নড়ে না। এর কারণ হলো, বামদিকের আর ডানদিকের বলপ্রয়োগ সমান হয়ে যাবার কারণে টেবিল স্থির হয়ে ছিলো। কিন্তু যখন সবাইকে বলা হলো টেবিলটা শুধু ডানদিকে নড়বে, তখনই দেখা গেলো অশরীরি এসে হাজির হয়েছে আর টেবিল ঐ নির্দিষ্ট দিকে তার কাঁপাকাঁপি শুরু করে দিয়েছে।

'দুর্ধর্ষ বিজ্ঞানী' নাকি 'দুর্ধর্ষ ভূতের ওঝা' আপনারাই বিবেচনা করুন!

‘দুর্ধর্ষ বিজ্ঞানী’ নাকি ‘দুর্ধর্ষ ভূতের ওঝা’ আপনারাই বিবেচনা করুন!

একই নীতি প্রয়োগ করা যায় ওইজা বোর্ডের ক্ষেত্রেও। কাঠের যে নির্দেশিকাটা আমাদের আসরের ‘মিডিয়াম’ ধরে রাখে, তার পেশীর অনৈচ্ছিক নড়াচড়ার কারণেই অবচেতন মন হতে কাল্পনিক সব নির্দেশ পেয়ে সে বানান করে করে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে থাকে।

২। অটোম্যাটিজম (Automatism)

আত্মাদের সাথে যোগাযোগের আরেকটা উপায় হলো ‘চ্যানেলিং’। এটাই সম্ভবত মানবসভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে পুরাতন পদ্ধতি যেটা দিয়ে আত্মাদের সাথে যোগাযোগ করা হতো। চ্যানেলিং এর ব্যাপারটা হলো- একদম পরিচ্ছন্ন, নির্ঝঞ্জাট মনে ধ্যাণে বসতে হয়। মহাজাগতিক চেতনায় নিজেকে পুরোপুরি ডুবিয়ে দিতে হয়। তখন বহু শতাব্দী আগে মারা যাওয়া কারো আত্মা এসে সেই জীবিত মানুষের শরীরে ভর করে। প্রাচীণ সব ধর্মের পুরোহিতরা দাবি করতো মৃত আত্মাদের সাথে তাদের যোগাযোগের ক্ষমতার। লাইভ টিভি শোতেও অনেকে এই ধরণের ক্ষমতা প্রদর্শন করেছেন। J.Z. Knight নামক এক মিডিয়ামের দাবি তিনি ‘রামথা’ নামক এক ৩৫,০০০ বছরের পুরনো আত্মার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন, যে কিনা হারিয়ে যাওয়া নগরী ‘আটলান্টিস’ এর বাসিন্দা ছিলো। যথারীতি এখানেও ধাপ্পাবাজদের অভাব নেই। কিন্তু যারা প্রকৃতই এটার চর্চা করে থাকেন তারা? তাদের এই ক্ষমতার ব্যাখ্যা কি?

ব্যাখ্যা হলো ‘অটোম্যাটিজম’, যেখানে তথাকথিত ভূতে ভর করা ব্যক্তি কি বলছে বা কি করছে সেটার প্রতি কোন খেয়ালই তার নেই। যখন ‘সাইকিক’ তার ধ্যানে বসেন তখন শুরুতেই তিনি সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে মনকে প্রস্তুত করে নেন সেখানে এক অশরীরি এসে ভর করার জন্যে। প্রচলিত ধারণা হলো অশরীরি এসে তার ভেতর ভর করবে এবং তাকে জগতের গোপনীয় সব জ্ঞান প্রদান করবে। বাকি সবাই মনে করবে এটা আসলে অন্য স্তরের কোন অস্তিত্বের মারফতে আসা জ্ঞান।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যেটা ঘটছে সেটা হলো- সাইকিক বা মিডিয়াম তার অবচেতন মনের অতি অতি গহীণে হারিয়ে যাচ্ছেন। সাধারণ মানুষেরা সবসময় এত সহজে মনের এত গহীনে ডুব দিতে পারেনা। কিন্তু একবার যদি কেউ ডুব দিতে পারতেন তবে দেখতেন সেখানকার চিন্তা-ভাবনা কত বিচিত্র। কতবার আপনি জীবনে প্রায় শূণ্য হতে উড়ে আসা একেকটা আইডিয়া হতে অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন? হিসাব নেই। এমনো হয়েছে সেইসব আইডিয়া মনের ভেতর আসার আগপর্‍যন্ত আপনি এমন কোন ধ্যান-ধারণার সাথে পরিচিতই ছিলেন না।

বাস্তবে আসলে আপনি উঁচুস্তরের কোন অস্তিত্বের মারফতে নতুন ধ্যান-ধারণা পাচ্ছেন না। আসলে আপনি আপনার মস্তিষ্কের অবচেতন অংশটাকে ঘাড় ধরে বসিয়ে অফিসে ওভারটাইম করাচ্ছেন।

৩। পরিচলন (Convection)

আপনি একটা ভূতুড়ে বাড়ীতে গেলেন গভীর রাতে। সেখানে ঘুরে বেড়ানোর সময় আচমকা গায়ে একটা ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা লাগলো। আপনি চমকে সেখান হতে একটু পাশে সরে গেলেন। দেখলেন এখানকার বাতাসটা ঠিকই আছে। আগের স্থানটার মত অতটা ঠান্ডা নয়। প্যারাসাইকোলজিস্টরা এটাকে বলেন ‘কোল্ড স্পট’। ভূত শিকারীদের মতে কোল্ড স্পট হলো “পুকুরের নির্দিষ্ট অংশে ছিপ ফেলে মাছ ধরা”র মত ভূত ধরার জায়গা। যখন প্রেতাত্মারা অলস সময় কাটায় তখন হাতের কাছে শিকার পেলে তারা শূন্য হতে আমাদের জগতে আবির্ভূত হয় আর ঐ বেচারা মানুষটাকে ভয় দেখিয়ে মজা পায়। এই শূন্য হতে আমাদের জগতে আবির্ভূত হতে শক্তি বা energy’র প্রয়োজন। তাই ভূতেরা যেই জায়গায় আবির্ভূত হয় সেই স্থানের তাপ শোষণ করে ফেলে।

ghost-7-the-real-life-science-behind-the-existence-of-ghosts-might-ease-your-fears-jpeg-225260

এটাতো গেলো প্যারাসাইকোলজিস্টদের ‘বিজ্ঞানভিত্তিক (!)’ মতবাদ। এবার আসুন শুনি, বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানভিত্তিক মতবাদ। বিজ্ঞানীরা যেমন বোরিং মানুষ, তাদের তত্ত্বগুলোও তেমন বোরিং। তাদের মতে এটা ‘বায়ুর পরিচলন’ প্রক্রিয়া ব্যতিত আর কিছুই নয়। অনেক ‘শীতল স্থান সম্বলিত’ বাড়িই ঘুরে দেখা গেছে সেখানে কোন ঘুলঘুলি কিংবা চিমনির মত জায়গা আছে যেটা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ভিতরে প্রবেশ করছে। যেহেতু ভিতরের পরিবেশ নিস্তব্ধ, গুমোট- তাই বায়ুর পরিচলন অতি সামান্যমাত্রায় হয়ে থাকলেও সেটা ধরা পড়ে যাচ্ছে।

কিন্তু পুরোপুরি বদ্ধ রুমের ভেতরে এটা কিভাবে সম্ভব? সেটাও সম্ভব। প্রতিটা বস্তুর আলাদা আলাদা তাপমাত্রা আছে। কোন কোন বস্তুর পৃষ্ঠদেশ অন্য কোন বস্তুর পৃষ্ঠদেশ হতে কোন কারণে একটু বেশি উত্তপ্ত হয়ে থাকতে পারে। তখন ‘কক্ষ তাপমাত্রায়’ নেমে আসার জন্যে সেই উত্তপ্ত পৃষ্ঠ তাপ ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করে। বায়ুর পরিচলন প্রক্রিয়ায় গরম বাতাস হালকা হয়ে উপরে উঠে পড়ে এবং ঠান্ডা বাতাস মাটির কাছাকাছি নেমে আসে। একইভাবে যখন অনার্দ্র বা শুকনো বাতাস কোনভাবে একটা আর্দ্র বাতাসসম্পন্ন বদ্ধরুমে প্রবেশ করে, তখন সেই অনার্দ্র বাতাসটা মাটির কাছাকাছি চলে যায় এবং বাতাসের আর্দ্র অংশটা চলে যায় উপরে ছাদের কাছাকাছি। এর ফলে আপনি টের না পেলেও ঐ বদ্ধরুমেই বাতাসের একটা মৃদু ঘূর্ণন শুরু হয় যেটার সংস্পর্শে এলে ঠান্ডা, গা শিরশিরে অনুভূতি হয়। সুতরাং এরপর হতে ঘরে এমন ‘কোল্ড স্পট’ খুঁজে পেলে ভূতের আছর দূর করতে তাবিজের বদলে রুম হিটারের ব্যবস্থা করুন!

৪। বৈদ্যুতিক স্টিমুলেশান (Electric Stimulation)

যারা ভূত দেখার ঘটনার সাক্ষী তারা সবাই স্বীকার করেন ছায়ামূর্তির মত অবয়ব দেখার। এই ছায়ামূর্তিরা চোখের কোণায় কিছু মূহুর্তের জন্যে দেখা দিয়েই এরপর হাপিস হয়ে যায়। অনেকে মনে করেন এই ছায়ামূর্তিরা হচ্ছে পিশাচ। কেউ মনে করেন এরা সময় পরিভ্রমণকারী, পরিভ্রমণের মাঝে একমুহুর্তের জন্যে শুধু দেখা দিয়ে গেছে। আর কারো কারো মতে এরা সব হচ্ছে এলিয়েন!

কিন্তু ছায়ামূর্তি দেখে শক খাবার পেছনের বৈজ্ঞানীক ব্যাখ্যাটাও যথেষ্ট শকিং। সুইজারল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা এক এপিলেপ্সিতে (Epilepsy) আক্রান্ত রোগীর মস্তিষ্কে বৈদ্যুতিক স্টিমুলেশান দেয়ার সময় তার প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিলেন। প্রতিক্রিয়া ছিলো ভয়াবহ। সেই রোগী জানালেন তিনি তার সামনে ছায়ার মত একটা অবয়ব দেখতে পাচ্ছেন যে কিনা সেই রোগীর প্রতিটা নড়াচড়ার হুবহু অনুকরণ করছে। যখন রোগী উঠে বসছেন তখন সেই ছায়ামানবটাও উঠে বসছে। যখন তিনি সামনে ঝুঁকে হাঁটু স্পর্শ করার চেষ্টা করছেন তখন ছায়ামূর্তিটাও তাই করছে। বিজ্ঞানীরা তখন রোগীকে একটা কার্ড দিয়ে সেটার লেখাগুলো পড়তে বললেন। কিন্তু তখন রোগী দেখলো ছায়ামূর্তিটা তার হাত হতে কার্ডটা টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে!

আসলে যা ঘটেছিলো তা হলো, বিজ্ঞানীরা সেই রোগীর মস্তিষ্কের বামপাশের টেম্পোরোপ্যারাইটাল জাংশান (Left Temporoparietal Junction)-এ স্টিমুলেশান দিচ্ছিলেন। সহজ কথায় বলতে গেলে, এটা হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্কের সেই অংশ যেটা পারিপার্শ্বিকতার সাপেক্ষে আমাদের শরীরের অবস্থান কোথায় এবং কি অবস্থায় আছে সেই তথ্য প্রতি মূহুর্তে আপডেট করে থাকে। আরো ভালোভাবে বলতে গেলে এটা আমাদের আপন অস্তিত্ব এবং অপরের অস্তিত্ব বুঝাতে সহায়তা করে। যখন বিজ্ঞানীরা এই অংশটায় স্টিমুলেশান দিচ্ছিলেন তখন এর পুরো কার্‍যপ্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটতে লাগলো। ফলে রোগী তার নিজের শরীরকে বুঝতে ব্যর্থ হলেন আর একই সময়ে তার দৃশ্যপটে একটা ছায়ামানবের জন্ম হলো যে কিনা ঐ রোগী যা করে সেটারই অনুকরণ করে চলে।

110202172300-large

বিজ্ঞানীরা বর্তমানে উপলব্ধি করেছেন এই পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে শুধু সুস্থ মানুষদের ভূত দেখাই ব্যাখ্যা করা যাবেনা, বরং স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা কেন তাদের আশেপাশে উদ্ভট সব জিনিসের অস্তিত্ব অনুভব করে সেটাও উপলব্ধি করে সেই অনুযায়ী তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যাবে।

কথা হচ্ছে এই প্রক্রিয়ায় সুস্থ মানুষদের ভূত দেখতে হলেতো প্রাকৃতিকভাবে বাইরে হতে মস্তিষ্কে বৈদ্যুতিক স্টিমুলেশানের প্রয়োজন। কারণ তাদের মস্তিষ্কতো আর স্কিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের মত স্বয়ংক্রিয়ভাবে যেখানে সেখানে ভূত দেখার জন্যে তৈরি হয়নি। এই বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র আসবে কোথা হতে?

তাহলে চলুন পরের পয়েন্টে।

৫। ইনফ্রাসাউন্ড (Infrasound)

আপনি কি জানেন- এই পর্‍যন্ত যেসব স্থানে ভূতের দেখা পাওয়া গেছে দাবি করা হয়েছে, সেই সবকটা স্থানেই বিজ্ঞানীরা যন্ত্রপাতি দিয়ে প্রচন্ড প্রতিক্রিয়াশীল তড়িৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্রের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন? এইসব ক্ষেত্রের উৎস কি সেটায় যাবার আগে ভূত দেখার আরেকটা কার্‍যকারণ উল্লেখ করে নেই। সেটা হলো ‘ইনফ্রাসাউন্ড (Infrasound)‘।

গবেষক ‘ভিক ট্যান্ডি’ তার ল্যাবরেটরিতে একাকী কাজে ব্যস্ত থাকার সময় হঠাৎ একটা ধূসর রঙের ছায়ামূর্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন তার ডেস্কের কিনারা ধরে। প্রথমে তিনিও ধরে নিয়েছিলেন তার কর্মক্ষেত্রে নিশ্চয়ই ভূতের আছর হয়েছে। তাই সেদিনকার মত কর্মবিরতি ঘোষণা দিয়ে একলাফে সিঁড়ি এবং পরের লাফে তার গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ায় তিনি ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই পরদিন তিনি তার অফিসে গিয়ে কক্ষটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। তখনই একটা ব্যাপার তার চোখে পড়লো। গবেষক ভিক ছিলেন ‘ফেন্সিং (Fencing)’ খেলার ভক্ত। তিনি তার ফেন্সিং খেলার স্টিলের তরবারিটা দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। তিনি খেয়াল করে দেখলেন সেটা নিজে থেকেই কেমন যেন কাঁপছে। তখনই পুরো ব্যাপারটা তার মাথায় ‘ক্লিক’ করে উঠলো। তিনি উপলব্ধি করলেন যে বলের কারণে তরবারিটা কাঁপছে, সেই বলের কারণেই তিনি ভূত দেখতে পেয়েছিলেন। ভিক আসলে ইনফ্রাসাউন্ডের কারসাজির শিকার!

infrasound

আমাদের মানুষদের শ্রবণক্ষমতার সীমা নিম্নে ২০ হার্জ হতে উপরে ২০,০০০ হার্জ পর্‍যন্ত। ২০ হার্জের নিচের কোন শব্দই আমরা শুনতে পাইনা। এই সীমার নিচের শব্দকেই বলে ইনফ্রাসাউন্ড। আমরা ইনফ্রাসাউন্ড শুনতে পাইনা, কিন্তু সেটার কম্পন ঠিকই অনুভব করতে পারি। ইনফ্রাসাউন্ড প্রতিনিয়ত আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই অতি মৃদু কম্পনের কারণে হঠাৎ বিষন্নতা হতে শুরু করে অস্থির অস্থির লাগা পর্‍যন্ত অনেক কিছুই ঘটতে পারে আপনার সাথে। ইনফ্রাসাউন্ডের কারণে অনেকে গাড়িতে চড়ার সময় বমি করে থাকেন। ডঃ রিচার্ড ওয়াইজম্যান বলেন, “আমরা এই তরঙ্গগুলোকে অনুভব করে থাকি সবসময়, বিশেষত আমাদের পাকস্থলীতে, এবং এর ফলে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া যেমন ঘটতে পারে (কোন কারণ ছাড়াই মনে ফূর্তিভাব চলে আসা) তেমনি নেতিবাচক অনুভূতিও হতে পারে (হঠাৎ অস্বস্তি লাগতে থাকা)। যদি আপনার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ উপযুক্ত হয় তবে এই তরঙ্গরা আপনার মনে হঠাৎ তীব্র আতংকের সঞ্চারও করতে পারে”।

ইনফ্রাসাউন্ড প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হতে পারে ঝড়ো আবহাওয়া হতে (ভূত দেখার পারফেক্ট সময়), বিজলী চমকানো হতে, দমকা বাতাস হতে, এমনকি নিত্য ব্যবহার্‍য আসবাবপত্র হতেও! চলুন ফিরে যাই ভিক ট্যান্ডির ঘটনায়। তিনি যখনই ইনফ্রাসাউন্ডের ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন তখনই তিনি খুঁজতে লাগলেন অফিসকক্ষে নতুন কি সংযোজন করা হয়েছে যার ফলে হঠাৎ এই তরঙ্গের আগমন। তিনি খুঁজে পেলেন একটা নতুন পাখা ভেন্টিলেশন সিস্টেমে যুক্ত করা হয়েছে। তিনি এই পাখাটার ব্যাপারে জানতেন না। যন্ত্রপাতি দিয়ে মেপে দেখলেন পাখার কারণে ঠিক ১৯ হার্জ সমমানের তরঙ্গ উৎপন্ন হচ্ছে, যা কিনা আমাদের নিম্নতম শ্রবণসীমা হতে মাত্র এক হার্জ কম। এই কম্পনাংকের তরঙ্গ ট্যান্ডির চোখকে মৃদু মৃদু কাঁপাচ্ছিলো যার কারণে তিনি চোখের সামনে উদ্ভট ছায়ামূর্তি দেখতে পাচ্ছিলেন। যখন ট্যান্ডি মেইন্ট্যান্যান্সের লোকজন ডাকিয়ে পাখাটাকে বন্ধ করালেন তখন অনুমান করুন কি ঘটেছিলো? আর কোন ভূতের অস্তিত্ব নেই!

একইভাবে ডঃ ওয়াইজম্যান  বিশ্বাস করেন এই কম্পনগুলোই আসলে প্যারানর্মাল বা অতিপ্রাকৃত ঘটনাবলীর জন্যে অধিকাংশে দায়ী। উদাহরণস্বরুপ, আন্ডারগ্রাউন্ডের দুইটা ভূতুড়ে জায়গা পরিদর্শন করতে গিয়ে তদন্তকারীরা দেখলো দুই জায়গাতেই টানেলের উপরের রাস্তার গাড়িঘোড়ার চলাচলের কারণে ইনফ্রাসাউন্ডের ব্যাপক উপস্থিতি।

(পরের পর্বে সমাপ্য)