ইগনাজ ফিলিপ সেমলভাইস – যাঁর বৈপ্লবিক আবিষ্কার মেনে নেয়নি মানুষ

মীনা কার্টুনের সেই পর্বটার কথা মনে আছে? মীনা আলাদিনের জাদুর চেরাগের থেকে দৈত্য বের করে আনে। পরে তার কাছে তিনটা ইচ্ছাপূরণের কথা প্রকাশ করে। সবাই যেখানে ধন-দৌলত, প্রাসাদ-অট্টালিকা চায়; সেখানে আমাদের মীনা চেয়েছিলো সবার জন্যে নিরাপদ পানি আর পরিচ্ছন্ন ভাবে হাত ধোয়ার সুব্যবস্থা। তার ইচ্ছার কথা শুনে চেরাগের জ্বিনের চোখ কপালে উঠে গিয়েছিলো। এতো দামী দামী জিনিস রেখে সে এসব চেয়ে বেড়াচ্ছে কেন? পাগল নাকি! যদিও পরে মাথা চুলকাতে চুলকাতে জ্বিন মীনার ইচ্ছাগুলো ঠিকই পূরণ করে দিয়েছিলো।

মীনাকে চেরাগের জ্বিন বোকা ভাবলেও ঘটনা অন্তত আর আগে না বেড়ে সেই পর্যন্তই ছিলো। কিন্তু ইতিহাসে এমন এক ব্যক্তি আছেন, যিনি মানুষজনকে হাত ধোয়ার কথা বলায় তাঁকে সবাই পাগল ঠাওরেছিলো। তাঁর হাত ধোয়ার পরামর্শে কান না দিয়ে তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করেছিলো। তাঁর চাকরি চলে গিয়েছিলো। শেষে তাঁকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিলো পাগল হয়ে যাবার অভিযোগে। আর তাঁকে নিয়ে ট্রল করার মাঝের সময়টাতে সঠিকভাবে হাত না ধোয়ার কারণে মারা গিয়েছিলো আরো বহু মানুষ। আমাদের আজকের লেখাটা সেই ব্যক্তিকে নিয়ে। তাঁর নাম ‘ইগনাজ ফিলিপ সেমলভাইস’। জন্মসূত্রে তিনি হাঙ্গেরিয়ান। তাঁকে ধরা হয় মেডিকেলে সার্জারিতে এন্টিসেপ্টিক পদ্ধতি অনুসরণের পথিকৃৎ হিসেবে।

১৮৫০ সাল নাগাদ ইউরোপে সন্তান জন্মদানের অবস্থা খুব একটা সুবিধাজনক ছিলো না। সেখানকার চাইল্ড কেয়ার ক্লিনিকগুলোতে প্রায়ই Puerperal Fever নামক জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মা ও শিশুর মৃত্যু ঘটতো। এটাকে ‘চাইল্ডবেড ফিভার’ নামেও ডাকা হয়। সেই সময় যদি বাসাবাড়িতে ধাত্রীর মাধ্যমে সন্তান প্রসব করানো হতো, তবে হাজারে হয়তো ৫ জন মা মারা যেতেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে হাসপাতালে এই মৃত্যুর হার ছিলো আরো বেশি। প্রায় ১০-১৫ গুণ! কিন্তু কেন, সেই প্রসঙ্গে একটু পরেই আসছি।

আমাদের আলোচ্য ব্যক্তি ইগনাজ সেমলভাইস ১৮৪৬ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় এক জেনারেল হাসপাতালে প্রসূতি সেবা বিভাগের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। তাঁর অধীনে দু’টো ওয়ার্ড ছিলো। একটায় প্রফেশনাল ডাক্তাররা সেবা দিতেন, আরেকটায় ধাত্রীবিদ্যা জানেন কিন্তু ডাক্তারি ডিগ্রি নেই, এমন সাধারণ মানুষজন সেবা দিতেন। এই হাসপাতালগুলো খোলা হয়েছিলো মূলত পরিবার ও সমাজ যেসব মা ও সন্তানের দায়ভার নিতে চায় না (যেমন – যৌনকর্মী), তাদের কথা স্মরণে রেখে। তা না হলে ঐসময়ে সাধারণত বাড়িতে ধাত্রী ডেকে এনেই সন্তান প্রসব করানো হতো। এখন এদের মধ্যে যাদের পকেটের অবস্থা ভালো, তারা প্রথম ওয়ার্ডে সেবা নিতেন। আর যাদের বাচ্চা জন্মদানের খরচ বহন করার সামর্থ্য নেই, তারা যেতেন দ্বিতীয় ওয়ার্ডে।

কথা হলো, প্রথম ওয়ার্ডে রোগীদের চাইল্ডবেড ফিভারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার ছিলো ১০%। আর দ্বিতীয় ওয়ার্ডে এই মৃত্যুহার ছিলো ৪%। অর্থাৎ, যে ওয়ার্ডে প্রফেশনাল ডাক্তারেরা সেবা দিতেন, সেখানে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার ছিলো দুস্থ-গরীবদের জন্যে খোলা ওয়ার্ডের মৃত্যুহারের চেয়ে বেশি। সাধারণ ধাত্রীদের হাতে অনেক বেশি সংখ্যক শিশু সুস্থ শরীরে জন্ম নিয়ে মায়ের কোলে বাসায় ফিরে যাচ্ছিলো। প্র্যাক্টিক্যালি, প্রথম ওয়ার্ডে টাকা দিয়ে সন্তান প্রসব করানোর চেয়ে দ্বিতীয় ওয়ার্ডে বিনা পয়সায় সন্তান প্রসব করানো ভালো। আর সেটার থেকেও ভালো কোনো হাসপাতালে না গিয়ে রাস্তায় সন্তান প্রসব করালে!

“কি! হাসপাতালের দ্বিতীয় ওয়ার্ডে সিট খালি নাই!! ড্রাইভার সাব, আমাকে সাইডে চাপায়ে নামায় দ্যান। আমি রাস্তাতেই বাচ্চা প্রসব করাবো।”

যাই হোক, হাসপাতালের এই পরিসংখ্যানটা ঐ অঞ্চলের কমবেশি সকলেরই জানা ছিলো। ফলে সকলেই প্রফেশনাল ডাক্তারদের ওয়ার্ডে ভর্তি না হয়ে দ্বিতীয় ওয়ার্ডে ভর্তি হতে চাইতো। এতে করে এমেচার ধাত্রীদের সামনে পড়াশুনা জানা ডাক্তারদের ইজ্জতের ফালুদা হবার দশা হলো। ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব পেয়েই এই ব্যাপারটা নিয়ে কাজ শুরু করলেন সেমলভাইস। তাঁর নিজের ভাষ্যেই, “এই ব্যাপারটা এতো বেশি পীড়া দিচ্ছে যে, জীবনটাকে অর্থহীন মনে হচ্ছে।” তিনি দুই ওয়ার্ডকে পর্যবেক্ষণে রাখা শুরু করলেন। দুই ওয়ার্ডে যে সব ব্যাপারে পার্থক্য আছে, সেগুলো নোট করা শুরু করলেন।

এখন পর্যন্ত পার্থক্য এক জায়গাতেই। প্রথম ওয়ার্ডে প্রফেশনাল ডাক্তার, দ্বিতীয় ওয়ার্ডে সাধারণ ধাত্রীবিদ্যা জানা মানুষেরা। বেশি মানুষের জনসমাগমকে সেমলভাইস শুরুতেই বাদ দিয়ে দিলেন। কারণ দ্বিতীয় ওয়ার্ডে মানুষ বেশি ভর্তি হতে চাইতো। তাতে রোগীর সংখ্যা ছিলো অত্যধিক। কিন্তু মৃত্যুহার ছিলো ঐখানেই কম। সুতরাং এই পথে আগানো অর্থহীন। তাই তিনি অন্য সব দিকে পার্থক্য খুঁজে বেড়াতে শুরু করলেন। কিছুদিন বাদেই সেমলভাইস দেখলেন, প্রথম ওয়ার্ডে মায়েদের পিঠের উপরে ভর দিয়ে শুইয়ে সন্তান প্রসব করাচ্ছেন ডাক্তারেরা, যেখানে দ্বিতীয় ওয়ার্ডে ধাত্রীরা মায়েদের পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে সন্তান প্রসব করান। এটাই কি তবে কারণ হতে পারে? সেমলভাইস নির্দেশ দিলেন প্রথম ওয়ার্ডেও মায়েদের পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে সন্তান প্রসব করাতে। তাঁর কথা অনুযায়ী তাই শুরু করা হলো। কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করে ফলাফল পাওয়া গেলো শূন্য। চাইল্ডবেড ফিভারে মৃত্যুহার সেই একই। পাশ ফিরে শোয়া না শোয়ার সাথে এই জ্বরের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য!

তার কিছুদিন বাদে আরেকটা ব্যাপার নজরে পড়লো সেমলভাইসের। যখন কোনো রোগী মারা যেতেন চাইল্ডবেড ফিভারে, তখন হাসপাতালের চার্চের একজন যাজক সেই রোগীর বেডের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেন। তার পেছন পেছন একজন অ্যাটেনডেন্ট হাতে ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে হাঁটতো। সেমলভাইস ভাবলেন, যাজককে দেখে এবং তার ঘণ্টার শব্দ শুনে রোগীরা কি আঁতকা ভয় পেয়ে উঠে নাকি, যাতে গায়ে জ্বর চলে আসে আর রোগী মারা যায়? কোনো কারণে প্রথম ওয়ার্ডে বেশি রোগী মারা যাওয়ায় যাজক বেশিবার এসেছিলেন ওখানে। তাকে দেখে এবং ঘণ্টার শব্দ শুনে আরো বেশি রোগী মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে গেছে। ফলে চেইন রিঅ্যাকশনে আরো বেশি রোগী মারা গেছে। ব্যাপারটা কি এমন? এই সব আবোলতাবোল ভেবে তিনি যাজককে বললেন, রোগী মারা গেলে হাসপাতালের ভিতর দিয়ে তিনি যাতে অন্য পথ ধরে হাঁটেন। যাজক তাই শুরু করলেন। কিছুদিন পরে দেখা গেলো এতেও ফলাফল শূন্য। জ্বর আসা না আসার পেছনে যাজক এবং তার ঘণ্টার কোনো প্রভাব নেই। এই জ্বর পুরা নাস্তিক, যাজক এবং তার ঐশ্বরিক ঘণ্টার বাজনাকে ভয় পায় না!

এই পর্যায়ে সেমলভাইসের মেজাজ পুরো বিলা হয়ে গেলো। হতাশায় তিনি কিছুদিন ছুটি কাটাতে চাইলেন। ছুটি নিয়ে চলে গেলেন তিনি ভেনিসে। বেশ দীর্ঘ একটা ছুটি কাটিয়ে যখন তিনি হাসপাতালে ডিউটিতে ফিরলেন, তখন কানে এলো একটা দুঃসংবাদ। তাঁর এক কলিগ, যিনি ছিলেন প্যাথলজিস্ট, অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন। জ্বর হয়েছিলো তার। ঐ সময়ে প্যাথলজিস্টদের জ্বরের ফলে মৃত্যু সংবাদ একটু বেশিই নিয়মিত ছিলো। প্যাথলজিস্ট সমাজের সদস্যদের জ্বরের কারণে মৃত্যুর খবর বেশ ঘনঘন পাওয়া যেতো। সেমলভাইসের কলিগ একটা লাশের অটোপসি করার সময়ে সুঁইয়ের খোঁচা খেয়েছিলেন আঙ্গুলে। এরপরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান।

সেমলভাইস তাঁর সেই কলিগের জ্বরের লক্ষণগুলো ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করলেন। করে দেখলেন, হাসপাতালের গর্ভবতী মায়েদের মতো তাঁর কলিগও ঠিক একই জ্বরে মারা গেছেন। এইটাই ছিলো পুরো ঘটনার মোড় ঘুরে যাওয়ার সূত্রপাত। সেমলভাইস হাইপোথিসিস দাঁড় করালেন যে, কেন প্রথম ওয়ার্ডে প্রফেশনাল ডাক্তারদের হাতে অনেক বেশি পরিমাণে রোগী মারা যাচ্ছে! কারণ প্রথম ওয়ার্ডের ডাক্তারেরা প্রায়ই লাশের অটোপসি করেন, যেটা দ্বিতীয় ওয়ার্ডের ধাত্রীদের করতে হয় না। তার মানে লাশের শরীরে এমন কিছু বিষাক্ত পদার্থ থাকতে পারে, যেগুলো অটোপসি করা ডাক্তারদের হাতে করে চলে যাচ্ছে মায়েদের শরীরের ভেতরে। পরে তাদের শরীরে বিষক্রিয়া ঘটিয়ে আনছে জ্বর। তাতে মারা যাচ্ছেন মায়েরা। সেমলভাইস এই বিষাক্ত পদার্থগুলোর নাম দিলেন ‘Cadaverous Particles’ বা শব কণা। (বর্তমানে এই রোগের জন্যে দায়ী করা হয় ‘Group A hemolytic streptococcus’ জীবাণুদের)

Group A hemolytic streptococcus

তিনি নির্দেশনা জারি করলেন, ডাক্তারেরা যাতে ক্লোরিন দিয়ে ভালোমতো হাত এবং সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি ধুয়ে তারপরে মায়েদের সন্তান প্রসব করান। এখন পর্যন্ত ক্লোরিন সেরা জীবাণুনাশকগুলোর মধ্যে একটা। কিন্তু সেমলভাইসের সময়ে তিনি কিংবা অন্য কোনো মানুষ জীবাণুর ব্যাপারে তেমন জানতেন না। সেমলভাইসের স্রেফ মনে হয়েছিলো, হাত থেকে লাশের গন্ধ দূর করতে ক্লোরিন বেশ ভালো এক পরিষ্কারক পদার্থ। তাই তিনি সবাইকে ক্লোরিন দিয়ে হাত এবং সার্জিকাল যন্ত্রপাতি ধোবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এই নির্দেশনা পালন শুরু হবার পরেই নাটকীয়ভাবে প্রথম ওয়ার্ডে রোগীদের মৃত্যুহার কমে গেলো।

কিন্তু ঘটনা প্যাঁচ লাগতে শুরু করলো অন্য দিক দিয়ে।

ঘটনার কারণ উপলব্ধি করে সকলের বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে যাবার বদলে ডাক্তারদের মেজাজ পুরো বিলা হয়ে গেলো। তাদের মনে হলো, যে ডাক্তারেরা জীবন বাঁচান তারাই রোগ ছড়িয়ে রোগীদের মারছেন, এমনটাই উপস্থাপন করা হচ্ছে জনসমাজে। ফলে সেমলভাইসের ধারণার বিপরীতে তীব্র প্রতিরোধ আসা শুরু করলো। ‘চার্লস ডেলুসেনা মেইগস’ নামের আরেক ডাক্তার ঘোষণা করলেন, কোনো ডাক্তার হাত ধুবে না। ডাক্তারেরা হচ্ছেন ভদ্রলোক। আর ভদ্রলোকদের হাতে ময়লা থাকে না।

“এই দেখেন! আমি জেন্টেলম্যান। আমার হাত আমি সবসময় বগলে ঢুকিয়ে রাখি। আমার হাতে কোনো ময়লা নাই।” – ডেলুসেনা মেইগ

মেইগসের গলার সুরে সুর মিলিয়ে এগিয়ে এলেন অন্য ডাক্তারেরাও। তারা কেউ হাত ধুবেন না। হাত না ধুয়েই তারা প্রসূতিদের সেবা দিবেন। ডাক্তারদের হাত ধোয়া মানে তারাই যে জ্বর ছড়াচ্ছে, সে কথা স্বীকার করে নেওয়া। এটা হতে দেয়া যাবে না। ডাক্তার মেইগের সাথে ‘জোহান ক্লাইন’ নামের আরেক ডাক্তার এসে যোগ দিলেন। এই দু’জনের তীব্র বিরোধিতার মুখে চাকরি চলে গেলো ডাক্তার সেমলভাইসের। তিনি ভিয়েনা ছেড়ে চলে গেলেন বুদাপেস্টে।

এরপরেও কয়েকবার তিনি বিভিন্ন হাসপাতালে চাকরির জন্যে আবেদন করেছিলেন। তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছিলো তাঁকে। ১৮৫১ সাল নাগাদ ‘যেইন্ট রোকুস’ হাসপাতালে বিনা বেতনে হেড ফিজিশিয়ানের দায়িত্ব নেন তিনি। সেখানেও ভীষণ চাইল্ডবেড ফিভারের সমস্যা ছিলো। সেমলভাইসের ক্লোরিন দিয়ে হাত ধোয়ার থেরাপিতে আশাতীত ফলাফল পাওয়া যায়। সেখানেও মায়েদের মৃত্যুহার হ্রাস পায়। তাঁর কাজের রিপোর্ট চলে যায় উপর মহলে। তারা যথারীতি খিক খিক করে হেসে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেন সেই সব রিপোর্ট। কেউ মানতেই চাননি ডাক্তারদের হাতের মাধ্যমে প্রসূতি মায়েদের শরীরে জ্বর ছড়ানোর ব্যাপারটা।

কয়েকটা পেপারও লিখেছিলেন সেমলভাইস তাঁর আবিষ্কৃত এই ব্যাপারটা নিয়ে। কিন্তু তাঁর পেপারের বিপরীতে পালটা পেপার লিখে হাত ধোয়ার ব্যাপারটাকে নাকচ করে দেন অনেকে। এর মধ্যে উপরে উল্লিখিত ডাক্তার ডেলুসেনা মেইগসও আছেন। পুরো ডাক্তার সমাজে হাসির পাত্র হয়ে উঠেন সেমলভাইস। ফেসবুক, ইন্টারনেট থাকলে হয়তো তাঁকে নিয়ে হাস্যকর সব মিম (Meme) বানানো হতো। বিভিন্ন পেইজে কুটি কুটি লাইক কামাতো সেই সব মিম (কারণ অধিকাংশ মানুষ বৈপ্লবিক চিন্তার বিপরীতে গিয়ে গতানুগতিক ধারায় থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, তা সেটা যতই সত্য কথা হোক না কেন)।

“হাত ধুতেই থাকো, ধুতেই থাকো……”

এই বৈপ্লবিক আবিষ্কারের মাত্র এক যুগের মাথায় সেমলভাইস পুরো হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। তিনি মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়লেন। নিয়মিত হারে যৌনকর্মীদের সাথে সময় কাটাতে শুরু করলেন। প্রায়ই মাতাল হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডাক্তারদের “কসাই, জানোয়ার, অশিক্ষিত গণ্ডমূর্খের দল” বলে গালাগাল করতেন। তাঁর পরিবারের লোকজনও তাঁর এই মেন্টাল ব্রেক ডাউনে অস্থির হয়ে পড়লো। তারা ১৮৬৫ সাল নাগাদ ভিয়েনার এক মানসিক হাসপাতালে চিঠি লিখলো সেমলভাইসের মানসিক অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে। সেই হাসপাতালের প্রধান ডাক্তার ফার্দিনান্দ রিটার ভন হেবরা এসে সেমলভাইসের সাথে পরিচিত হলেন। তাঁকে ভিয়েনার মানসিক হাসপাতালটা ঘুরিয়ে দেখাবার জন্যে সাথে যাবার আমন্ত্রণ দিলেন। সেমলভাইস খুশি মনেই রওনা হলেন তার সাথে। ১৮৬৫ সালের ৩০ জুলাই উপস্থিত হলেন সেখানে। কিন্তু সেখানে নিয়েই আটকে ফেলা হলো তাঁকে। এরপরে শুরু হলো পাগলের চিকিৎসা, হাত-পা বেঁধে শক্ত করে মার দেয়া। হ্যাঁ, সেই আমলে ইউরোপের মানসিক হাসপাতালগুলো “মাইরের উপরে ভাইটামিন নাই” নীতিতেই চলতো।

মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায়, ১৮৬৫ সালের ১৩ আগস্ট মারা যান সেমলভাইস। মারা যাবার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় শক্ত মারের কারণে শরীরে বেশি ভিটামিন ঢুকে যাওয়াকে (সারকাজম এলার্ট)! দু’দিন বাদে ১৫ আগস্ট সমাহিত করা হয় তাঁকে ভিয়েনাতে।

সেমলভাইসের ১৮৪৫ সালে আবিষ্কৃত হাত ধোয়ার ধারণা যে কতোটা যুগান্তকারী ছিলো, সেটা বুঝতে আরো বহু বছর সময় লেগেছিলো মানুষের। লুই পাস্তুর এবং তাঁর প্রকাশিত জার্ম থিওরিকে প্রয়োজন পড়েছিলো মানব সভ্যতার, বিশেষত ডাক্তারদের, সেমলভাইসের হাত ধোয়ার ধারণাটাকে হজম করতে। কিন্তু যতদিনে তারা উপলব্ধি করেছিলো সত্যটা, ততদিনে সেমলভাইসকে পাগল বানিয়ে দুনিয়া থেকে বিদেয় করে দেয়া হয়েছে। অস্ট্রিয়া এবং হাঙ্গেরিতে বর্তমানে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয় ডাক্তার সেমলভাইসকে। সেই সাথে তাঁকে অভিহিত করা হয় “Saviour of Mothers” নামে।

যেইন্ট রোকুস হাসপাতালের সামনে প্রতিস্থাপিত ডাঃ সেমলভাইসের মূর্তি


তথ্যসূত্রঃ
————–
১। https://en.wikipedia.org/wiki/Ignaz_Semmelweis
২। http://www.pbs.org/newshour/updates/ignaz-semmelweis-doctor-prescribed-hand-washing/
৩। http://www.npr.org/sections/health-shots/2015/01/12/375663920/the-doctor-who-championed-hand-washing-and-saved-women-s-lives
৪। https://en.wikipedia.org/wiki/Charles_Delucena_Meigs