গণিতশাস্ত্রের দুর্ধর্ষ ১০ – ৫ম ও শেষ পর্ব

 

২। এমি নোদার (১৮৮২ – ১৯৩৫)

কে ছিলেন তিনি?
এমি নোদার’ ছিলেন একজন জার্মান গণিতবিদ। ১৮৮২ সালে তিনি জার্মানির বাভেরিয়ার ‘এরলানেন’ নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ‘ম্যাক্স নোদার’ ছিলেন মূলত একজন পাইকারি ব্যবসায়ী। এর আগে তিনি শিক্ষকতা করতেন। ম্যাক্স নোদার ছিলেন পুরোপুরি স্বশিক্ষিত। কিন্তু পরে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় হতে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষকতায় থাকাকালীনই তাঁর পরিচয় হয় এক ব্যবসায়ীর কন্যা ‘অ্যামেলিয়া কফম্যান’-এর সাথে। বিয়ের পরে তাঁদের ঘরেই প্রথম সন্তান হিসেবে আসেন অ্যামেলিয়া এমি নোদার। এমির পিতা ম্যাক্স নিজেও একজন স্বশিক্ষিত গণিতবিদ ছিলেন। ‘বীজগাণিতিক জ্যামিতি’ শাখার উপরে করা ম্যাক্সের অনেক গবেষণাকর্ম রয়েছে। “যেমন বাপ, তার তেমন মেয়ে”। বরং বলা যায় আরেকটু বেশী! এমি নোদার শুধু শুধু আমাদের তালিকায় আরো বাঘা বাঘা সব গণিতবিদদের ফেলে ২ নং অবস্থানে উঠে আসেননি। তাঁকে ধরা হয় বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণিতবিদদের একজন হিসেবে। এই লাইসেন্স আমরা বিজ্ঞানযাত্রার কেউ আবেগাপ্লুত হয়ে দিয়ে দেইনি। এই লাইসেন্স দিয়েছেন স্বয়ং অ্যালবার্ট আইনস্টাইন!

27ANGI-popup

কেন তিনি দুর্ধর্ষ?
১৯১৫ সাল নাগাদ আইনস্টাইন এবং ডেভিড হিলবার্ট আলাদা আলাদাভাবে তাঁদের জেনারেল রিলেটিভিটি সংক্রান্ত কাজগুলো গুছিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু একটা জায়গায় গিয়ে তাঁদের প্যাঁচ লেগে গেলো। সেটা হলো- শক্তি স্পেস-টাইমে আলোড়ন সৃষ্টি করে। আর স্পেস-টাইম শক্তিকে ধারণ করে। তার মানে কি স্পেস-টাইম নিজেই নিজের ভেতরে আলোড়ন তৈরি করছে? এই গোলকধাঁধায় পড়ে জিগস’ পাজলটার দিকে তাকিয়ে দুজনে গম্ভীরভাবে গালে হাত দিয়ে বসে রইলেন। পরে আইনস্টাইন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর গলায় বললেন- এই ধাঁধার সমাধানে আরো বড় গাণিতিক এক্সপার্টের সহায়তা লাগবে। এমিকে মোবাইলে কল দাও!

হিলবার্টের ‘কল’ পেয়ে ১৯১৫ সালে জার্মানির গ্যেটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে হাজির হলেন আমাদের এক্সপার্ট এমি নোদার। তিনি এসে জেনারেল রিলেটিভিটি বা সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নামক পাজলটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। পুরো ব্যাপারটা বুঝে নিলেন তিনি। হিলবার্ট বলতে চাইছেন- আইনস্টাইন মহাকর্ষের যে জ্যামিতিক মডেল দাঁড় করিয়েছেন, তাতে ‘শক্তির নিত্যতার সূত্র’-এর ইজ্জতের পুরো ফালুদা হয়ে যাবে! কারণ এই মডেল অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, মহাকর্ষীয় শক্তি নিজেই নিজেকে আকর্ষিত করে (হিলবার্টের ভাষায়,“……gravitational energy could itself gravitate”)।

নোদার পুরো ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে ভাবতে বসলেন। তারপর তিনি সমাধান দিলেন এই ধাঁধাঁর, আর জেনারেল রিলেটিভিটি পেয়ে গেলো তার পূর্ণতা। নোদারের এই সমাধান এখন ‘নোদার তত্ত্ব’ নামে পরিচিত। আইনস্টাইনের মতে- এই নোদার তত্ত্বের কারণেই আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান জন্মলাভ করতে সক্ষম হয়েছে। ব্যাপারটা এভাবে দেখা যায়, আইনস্টাইনের সন্তান ছিলো ‘সাধারণ আপেক্ষিকতা’, আর সেই সন্তান জন্মদান কালে ধাত্রী ছিলেন এমি নোদার। তিনি তাঁর অনন্য গাণিতিক প্রতিভা দিয়ে যে নোদার তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছিলেন, সেসবের লিখিত কাগজ-পত্র আইনস্টাইন হাতে পাবার পর তিনি হিলবার্টকে চিঠিতে লিখে জানান, “গতকাল আমি মিস নোদারের ইনভ্যারিয়েন্ট (invariant)-এর উপরে করা গবেষণার কাগজগুলো হাতে পেয়েছি। এই জিনিসগুলো যে এতো সহজে বুঝানো যায় তা আমার ধারণার বাইরে ছিলো। গ্যেটিঙ্গেনের প্রহরীরাও মনে হয় মিস নোদারের থেকে এগুলো শিখে ফেলতে পারবে। সে ব্যাপারগুলো সম্পর্কে দারুণ ধারণা রাখে”। ১৯১৫ সালেই তাঁর কাজ শেষ করলেও এই তত্ত্ব তিনি ১৯১৮ সালের আগ পর্যন্ত প্রকাশ করেননি।

নোদার ঐ তত্ত্বে কী বলেছিলেন, সেটা এখানে ব্যাখ্যা করলে আমাদের অর্ধেক পাঠকই ভেগে যাবেন। তাই আর ব্যাখ্যায় গেলাম না। শুধু বলি, ধরুন- আপনি কোনো একটা দোকানে গিয়ে টফি কিনতে চাইলেন। দোকানদার জানালো টফি চকলেট নেই তার কাছে। আছে ললিপপ চকলেট, কিনলে সেটা কিনতে পারেন। আপনি গেলেন পরের দোকানে। সেখানেও একই অবস্থা। শুধু তাই নয়, পুরো ১৫-২০ টা দোকান ঘোরা শেষে ফলাফল একই। শুধু ললিপপ আর ললিপপ! তখন আপনি কি উপলব্ধিতে আসবেন না, এই ব্যাপারটার পেছনে নিশ্চয়ই সংরক্ষণশীলতার একটা ল’ বা নীতি কাজ করছে?  নোদারের তত্ত্বও তাই বলে। স্পেস-টাইমের যেকোনো জায়গায়, যেকোনো সময়ে গেলেই যদি ঐ স্থানে কোনো এক্সপেরিমেন্ট বা পরীক্ষার ফলাফল একই থাকে, তবে ঐ সিস্টেমটার পেছনে কাজ করা পদার্থবিজ্ঞানের নীতিগুলো প্রতিসম (Symmetric) অবস্থায় আছে। সিস্টেমটা দেখতে প্রতিসম না হলেও চলবে। একটা দেখতে অপ্রতিসম (Asymmetrical) বস্তুর উপরে কাজ করা পদার্থবিজ্ঞানের নীতিগুলোও প্রতিসম অবস্থায় থাকে। যেমন- একটা আঁকাবাঁকা গ্রহাণু দেখতে অপ্রতিসম বস্তু হলেও এর উপরে ক্রিয়াশীল পদার্থবিজ্ঞানের নীতিগুলো প্রতিসম অবস্থায় আছে। ফলে সে কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণ করে, কোনো তারতম্য না ঘটিয়ে ছুটে চলছে মহাশূন্যে তার কক্ষপথে। তার আঁকাবাঁকা আকৃতি এটায় কোনো প্রভাব ফেলছে না।

"এতক্ষণ কী বললেন খেয়াল করিনি। টফি চকলেট আর গ্রহাণু দেখতে একই রকম- সেটা বলেছিলেন নাকি?"

“এতক্ষণ কী বললেন খেয়াল করিনি। টফি চকলেট আর গ্রহাণু দেখতে একই রকম- সেটা বলেছিলেন নাকি?”

এমন এক এক্সপার্ট তাঁর কর্মজীবনের পুরোটাই কাটিয়েছেন শিক্ষকতায়। তবে কথা হলো- সেই শিক্ষকতা জীবনের বড় একটা অংশ তিনি কাটিয়েছেন বিনা বেতনে চাকরি করে! ১৯০৮-১৯১৫ সাল পর্যন্ত তিনি এরলানেন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন বিনা বেতনে। কারণ তিনি নারী! বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে নারী বলে কাজ দিতে চায়নি। কিন্তু তিনি জেদের বশেই সেখানে বিনা বেতনে শিক্ষকতার কাজ করে যান। ১৯১৫ সালে হিলবার্ট তাঁকে গ্যেটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেকে নিয়ে যাবার পর এক পর্যায়ে নোদারকে সেখানে গণিত ডিপার্টমেন্টে চাকরি জুটিয়ে দেবার চেষ্টা করেন।  সেখানেও একই সমস্যা। নারী বলে তাঁকে চাকরিতে নেয়া হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষদের একজন বলেই বসলেন, “আমাদের সৈন্যরা ব্যাপারটা কীভাবে নেবে, যখন তারা যুদ্ধ হতে ফিরে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করে দেখবে একজন নারীর পায়ের কাছে বসে তাদের শিক্ষা নিতে হচ্ছে?”
জবাবে হিলবার্ট বলেছিলেন, “তাঁকে শিক্ষক নিয়োগের পিছনে তাঁর লিঙ্গ একটা সমস্যা, এই যুক্তির কোনো মাথামুণ্ডুই বুঝতে পারছি না আমি। আর যাই হোক, এটা তো একটা বিশ্ববিদ্যালয়, কোনো হেরেমখানা নয়”।
এমন জবাবের প্রত্যুত্তরে কর্তৃপক্ষ অটল রইলেন। ফলে আবারো শুরু হলো নোদারের বিনা বেতনে কর্মজীবন। তিনি সরাসরি শিক্ষক পরিচয় না দিয়ে হিলবার্টের সহকারী পরিচয়ের মাধ্যমে গ্যেটিঙ্গেনে শিক্ষকতা করতে লাগলেন। তাঁর থাকা-খাওয়ার খরচ যুগিয়েছিলো তাঁর পরিবারই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পরে ১৯১৮-১৯১৯ সালে ঘটা জার্মান বিপ্লবের ফলে সমাজে অনেক পরিবর্তন আসে। নারীরাও ধীরে ধীরে কর্মক্ষেত্রে তাদের অধিকার পেতে শুরু করেন। সেই সূত্রে প্রথম ১৯১৯ সালে নোদারকে প্রফেসর হিসেবে পদমর্যাদা দান করা হয়। কিন্তু বেতন তখনো শূন্য। বেতন পেতে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিলো আরো চারটা বছর। এই চার বছর তিনি শুধুমাত্র একটা পদ নিয়েই শিক্ষকতা করে গিয়েছিলেন। ১৯২৩ সালে তাঁকে অফিসিয়ালি প্রফেসর স্বীকৃতি দিয়ে বেতন দেয়া শুরু হয়। পরবর্তী জীবনে তিনি প্রচুর টাকা কামিয়েছিলেন, যেগুলো দিয়ে তাঁর চাকরি জীবনের শুরুর দিকের বছরগুলোতে থাকা-খাওয়ার খরচ সুদে-আসলে উঠে গিয়েছিলো। কিন্তু তখনো তিনি অতি সাদামাটা জীবনযাপন করতেন।

emmynoether
তাঁর ছাত্রদের মতে নোদার নিজের সম্পর্কে ছিলেন বেশ উদাসীন। গণিত প্রসঙ্গে কোনো আলাপ শুরু হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনর্গল কথা বলতে পারতেন তিনি। এই সময় নিজের প্রতিও তেমন খেয়াল থাকতো না। মাথার চুলগুলো পিন খুলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যেতে থাকলেও সেগুলোর দিকে ভ্রুক্ষেপ করতেন না। প্রায়ই দেখা যেতো, লেকচার দিতে দিতে মাথার ঘাম রুমাল দিয়ে মুছে সেটা আবার ব্যাগে না রেখে বুকের ব্লাউজের সাথে গুটিয়ে রেখেছেন। প্রয়োজনে সেখান হতে আবার রুমাল টেনে বের করে ঘাম মুছছেন। নোদার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস ধরে পড়াতেন না। বরং তাঁর ছাত্রদের সাথে গণিতের একটার পর একটা বিষয় নিয়ে সিরিয়ালে আড্ডার মতো আলাপ করে যেতেন। তাঁর কথাও ছিলো বেশ দ্রুত। এতেই বোঝা যায় কত দ্রুততার সাথে তিনি চিন্তা করতে সক্ষম ছিলেন। এর ফলে অনেকেই ত্যক্ত হয়ে তাঁর ক্লাস করা ছেড়ে দিতো। তখন নোদারের ছাত্ররা রসিকতা করে বলতো, “আরেকজন ময়দান ছেড়ে ভাগলো”। নোদারের এই তুখোড় ছাত্ররা গ্যেটিঙ্গেনে পরিচিত ছিলো ‘নোদার বয়েজ’ হিসেবে। এই নাম শুনেই সবাই বুঝে ফেলতেন এই ব্যক্তি অসামান্য শিক্ষক নোদারের গড়া ছাত্র।

১৯৩৩ সালে নোদার সরাসরি হিটলারের স্বাক্ষর সম্বলিত একটা চিঠি পান। সেখানে লেখা ছিলো- জার্মানির আর নোদারের কোনো প্রকার সার্ভিসের প্রয়োজন নেই। তাঁকে তাঁর চাকরি হতে ইস্তফা দেয়া হলো। শুধু নোদারই নন। বহু সংখ্যক ইহুদীকে এভাবে চাকরি হতে বের করে দিয়েছিলো হিটলার সরকার। তখন তারা অন্যান্য দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এবং হারম্যান ওয়েইল চলে আসেন আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। নোদার চলে আসেন আমেরিকায় ‘রক-ফেলার ফাউন্ডেশন’ পরিচালিত ‘ব্রিন মার’ কলেজে। সেখানেই তিনি তাঁর জীবনের শেষ দুটো বছর কাটান।

১৯৩৫ সালে তাঁর জরায়ুতে টিউমার ধরা পড়ে। ডাক্তাররা অপারেশন করে বড় একটা টিউমার সরিয়ে ফেলেন। কিন্তু আরো ছোট ছোট দুটো টিউমার তাঁরা তখনই ফেলতে পারেননি অপারেশন বেশী দীর্ঘ হয়ে যাবার ভয়ে। ফলে তাঁকে কয়দিন বেড রেস্টে রাখার সিদ্ধান্ত নেন ডাক্তাররা। তিনদিনে তিনি অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু একদিন পরেই হঠাৎ তাঁর গায়ের তাপমাত্রা প্রচণ্ড বেড়ে যায়। ১০৯ ডিগ্রী ফারেনহাইটে তাপমাত্রা উঠে গিয়ে ১৪ এপ্রিল ১৯৩৫ সালে অকালে মারা যান আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের জন্মধাত্রী এমি নোদার। গণিতশাস্ত্রে তাঁর অবদানের কথা আর নাই বা বললাম। এক পলক চোখ বোলাতে চাইলে, কেউ যেতে পারেন এই লিংকে দেয়া তালিকায়

দুর্ধর্ষতা রেটিং
তিনি শিক্ষকতার সূত্রে যত টাকা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে পাওনা আছেন, সেটার পরিমাণকে বর্তমান বাজারদরে রূপান্তর করে নিন। দশে উনার রেটিং তাই!

১। শ্রীনিবাস রামানুজন (১৮৮৭ – ১৯২০)

কে ছিলেন তিনি?
গণিতশাস্ত্রের ঈশ্বর। কথা শেষ!

Ramanujan
কেন তিনি দুর্ধর্ষ?
কারণ তিনি গণিতকে নিজের হুকুমের গোলাম বানিয়ে ছেড়েছিলেন।

পাঁচ পর্ব আগে যখন আমাদের এই সিরিজের প্রথম লেখাটা প্রকাশিত হয়, তখন সেখানে বলা হয়েছিলো গণিত নামক এক গহিন অরণ্যের কথা। বলা হয়েছিলো, কীভাবে আমাদের মতো চুনোপুঁটিরা সেই অরণ্যের বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকে ভেতর হতে ভেসে আসা সব জন্তু-জানোয়ারের গা হিম করা গর্জন শুনে। কিন্তু কেউ কেউ আছেন নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়েন সেই জঙ্গলে। টারজানের মতো খালি হাতে পিটিয়ে বশে আনেন সব জন্তু-জানোয়ারকে। পাঁচ পর্ব আগে ঐ বাক্যগুলো লেখা হয়েছিলো শ্রীনিবাস রামানুজনকে উদ্দেশ্য করে। গণিত তাঁর হুকুমের গোলাম। তিনি আগে নিজে নিজে গণিত শিখেছিলেন, তারপর দুনিয়ার তাবৎ গণিতবিদদের গণিত শিখিয়ে গিয়েছিলেন।

১৮৮৭ সালে তামিল নাড়ুতে জন্ম নেয়া রামানুজন ছিলেন ব্রাহ্মণ পরিবারের একমাত্র সন্তান। তাঁর আরো ভাই-বোন ছিলো। কিন্তু সবাই অল্প বয়সেই মারা যান। রামানুজন নিজেও একবার ভয়ংকর গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এই গুটিবসন্তে তাঁর গ্রামের বহু শিশু মারা গিয়েছিলো। কিন্তু টিকে গিয়েছিলেন রামানুজন। হয়তো তিনি পরে এককালে গণিতশাস্ত্রের ঈশ্বর হয়ে উঠবেন বলেই! তাঁকে পাঁচ বছর বয়সেই পাঠিয়ে দেয়া হয় দাদার বাড়িতে। সেখানে তাঁকে ভর্তি করা হয় ‘কাঙ্গায়ন প্রাইমারি স্কুল’-এ। তাঁর দাদা কিছুদিন বাদেই মারা গেলে তাঁকে রেখে আসা হয় নানার বাড়িতে। সেখানে নানা-নানীর তত্ত্বাবধানে থেকে স্কুলে ভর্তি হন তিনি। যাই হোক, সত্যি কথা হলো- রামানুজনের স্কুল কখনোই ভালো লাগেনি। তাই তিনি স্কুল পালাতেন। তাঁর স্কুল পালানোর মাত্রা এতোই বেড়ে যায় যে, তাঁর নানা বাধ্য হয়ে এলাকার স্থানীয় পুলিশ কনস্টেবলকে বলে রাখেন রামানুজন স্কুল পালাচ্ছে কিনা সেদিকে নজর রাখতে। ছোটবেলায় স্কুলে আমাদের শিক্ষকেরা রামানুজনের নামে পারলে পূজো দিতেন। কিন্তু এই সত্য কথাটা কেউ বলেননি কখনো আমাদের যে আসলে রামানুজন স্কুল পালিয়ে গণিতবিদ হয়েছিলেন। কে জানে আমরাও হয়তো স্কুল পালিয়ে এতোদিনে আবিষ্কারক-টাবিষ্কারক কিছু একটা হয়ে যেতে পারতাম। আফসোস!

"আজকে স্কুল পালিয়েই তো মনে হচ্ছে আমার আইকিউ ৪০ পয়েন্ট বেড়ে গেছে!"

“আজকে স্কুল পালিয়েই তো মনে হচ্ছে আমার আইকিউ ৪০ পয়েন্ট বেড়ে গেছে!”

স্কুল পালালেও তিনি স্কুল-কলেজ পাঠ পুরোটাই তুখোড় মেধার স্বাক্ষর রেখে শেষ করেন। তাঁর বয়স যখন ১১ বছর তখন তাঁর বাড়িতে লজিং থাকা দুই বড় ভাইয়ের কাছ থেকে খুঁজে পান স্কুল লেভেলের উচ্চতর গণিতের বই। আমরা ছোটবেলায় যেভাবে কমিক বুক গিলতাম, ঠিক সেভাবেই তিনি ঐ উচ্চতর গণিতের বইটা গিলে শেষ করে স্কুল লেভেলের উচ্চতর গণিতের গুষ্ঠি উদ্ধার করেন ১১ বছর বয়সে। তখন তাঁর প্রয়োজন হয়ে পড়ে আরো হায়ার লেভেলের ম্যাথমেটিকসের বই। তখন উপায় না পেয়ে তাঁর খিদে মেটাতে তাঁকে দেয়া হয় এস.এল. লোনির ত্রিকোণমিতির বই। ১৩ বছর বয়সে তিনি নিজে নিজে গণিতের বিভিন্ন তত্ত্ব আর সমীকরণ আবিষ্কার করতে শুরু করেন। আবার পড়ুন। ১৩ বছর বয়সে। নিজে নিজে গণিতের সূত্র আর সমীকরণ আবিষ্কার!

আর ঠিক সেই একই বয়সে আমাদের গাণিতিক প্রতিভার দৌড়ের এক সামান্য উদাহরণ......

আর ঠিক সেই একই বয়সে আমাদের গাণিতিক প্রতিভার দৌড়ের এক সামান্য উদাহরণ……

১৬ বছর বয়সে খিদের চোটে গিলতে শুরু করেন জি.এস.কারের লেখা অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিকসের উপরে বই। এই বইয়ে ৫০০০ গাণিতিক তত্ত্বের সংকলন ও প্রমাণ লিপিবদ্ধ আছে। ধরা হয়, এই বইটাই ‘জিনিয়াস’ রামানুজনকে ‘ঈশ্বর’ রামানুজনে পরিণত করেছিলো। ১৯০৫ সালে রামানুজন বাড়ি থেকে পালিয়ে যান, আর এক মাস গিয়ে বিশাখাপট্টমের রাস্তায় আর মন্দিরে ঘুরে জীবন কাটান। রামানুজন দাবি করতেন– দেবী লক্ষ্মী নাকি তাঁকে সবসময় স্বপ্নে পথ দেখাতেন। দিক-নির্দেশনা দিতেন। তাঁর ভাষ্যে- স্বপ্নগুলোও ছিলো বেশ ভয়াবহ। নারীর কাটা হাতের মতো কিছু একটা উড়ে এসে প্রথমে চক ধরে একটা গাণিতিক সমস্যা লিখতো দেয়ালে। তারপরে সেটার নিচে সরাসরি সমাধানটা লিখে দিতো। রাত দ্বিপ্রহরে ঘুম ভেঙ্গে যেতো রামানুজনের। তিনি তখন কাগজপত্র নিয়ে বসতেন কীভাবে ঐ সমাধানটা এলো, সেটা বের করতে। বাস্তবে ঘটনা কী ছিলো, সেটা জানা না গেলেও এটুকু জানা গেছিলো- রামানুজনের পাঠানো বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যার সমাধান অধিকাংশ গণিতবিদই বুঝে উঠতে পারেননি। কারো কাছে মনে হয়েছিলো এই সমাধান পাওয়া অসম্ভব, কেউ আবার রামানুজনকে স্রেফ ধাপ্পাবাজ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। অনেকে বিরক্ত হয়ে তাঁর পাঠানো কাগজগুলো খুলে পড়েও দেখেননি। রিটার্ন মেইলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কোনো প্রকার রিভিউ ছাড়াই। তবে একজন বাদে। তিনিই বুঝেছিলেন রামানুজনের মাহাত্ম্য। তিনি হলেন ইংরেজ গণিতবিদ জি.এইচ. হার্ডি

১৯১৩ সালের এক বসন্তে গণিতবিদ হার্ডি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভারত থেকে উড়ে আসা একটা মেইল খুললেন। চিঠিটা পাঠিয়েছিলেন ভারতের ম্যাথম্যাটিক্যাল সোসাইটির সভাপতি রামচন্দ্র রাও। চিঠি খুলে হার্ডি কিছুক্ষণ রামচন্দ্র রাওয়ের বক্তব্য পড়লেন। তারপর সংযুক্ত কাগজগুলোতে চোখ বোলাতে শুরু করলেন। মুহূর্তেই হেঁচকি উঠে বসন্তের সকালের চা-টা পুরো মাটি হয়ে গেলো তাঁর। রামানুজন নামে এক বালক নিচের ছবিতে দেখানো দুটো সিরিজের সমাধান পাঠিয়েছেন।

untitled
প্রথমটা হার্ডি আগেই জানতেন। কিন্তু দ্বিতীয়টার সমাধান শুধু হার্ডি কেন, পাশ্চাত্য অনেক গণিতবিদের কাছেই মনে হয়েছিলো পাওয়া অসম্ভব। এটাকে ডাকা হয় ‘হাইপারজিওমেট্রিক সিরিজ’ নামে। লিওনার্ড অয়লার এবং কার্ল ফ্রিদরিখ গাউসের মতো প্রতিভারা এই দ্বিতীয় সিরিজটাতে দাঁত ফুটানোর চেষ্টা করেছিলেন। বেশিদূর আগাতে পারেননি। সেখানে কোথাকার এক চ্যাংড়া রামানুজন এসে এভাবে তাঁকে চিঠিতে মধ্যাঙ্গুলি প্রদর্শন করে গেলো! হার্ডি তৎক্ষণাৎ চিঠি লিখতে বসলেন রামানুজনকে। আমন্ত্রণ জানালেন লন্ডনে আসার।

আমাদের রামানুজন তখন ভালো নেই। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে হন্যে হয়ে মাদ্রাজের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন একটা চাকরির জন্যে। দোকানে দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করছেন হিসাবের খাতা-পত্র দেখার জন্যে কোনো কেরানী তাদের প্রয়োজন আছে কিনা? রাতে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে ফিরে আসেন খুপরির মতো রুমে। এই সময় হাতে এলো তাঁর হার্ডির চিঠি। রামানুজন চিঠির জবাবে স্রেফ না জানিয়ে দিলেন। বলে দিলেন ব্রাহ্মণ হয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পরদেশে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। হার্ডিও নাছোড়বান্দা। তিনি এজেন্ট লাগিয়ে দিলেন রামানুজনের পেছনে তাঁকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে আসতে ইংল্যান্ডে। রামানুজন এক পর্যায়ে কিছুটা সম্মতি দিলেন। কিন্তু বাড়িতে তাঁর মাকে কী বলে বোঝাবেন? ইতিহাসে পাওয়া যায়– রামানুজনের প্রস্তাব শুনে তাঁর মায়ের হার্টফেল করার দশা হয়েছিলো। কিন্তু পরে একরাতে নাকি তিনি স্বপ্নে দেখেন দেবী লক্ষ্মী এসে তাঁকে বলছেন- রামানুজন এবং তাঁর জীবনের লক্ষ্যের মাঝে তাঁর মা যেন আর বাধা না হয়ে দাঁড়ান। বাস্তবে কী ঘটেছিলো, তা বেশ প্রশ্ন সাপেক্ষ।

১৯১৪ সালের ১৭ মার্চ ইংল্যান্ডের জাহাজে চড়ে বসেন রামানুজন। মাদ্রাজ ছেড়ে গিয়ে সেই জাহাজ ইংল্যান্ড পৌঁছায় ১৪ এপ্রিল। তিনি ইংল্যান্ডে টানা ছয় সপ্তাহ হার্ডির তত্ত্বাবধানে থেকে কাজ করেন। তাঁর নোটবুক উল্টে-পালটে দেখেন হার্ডি। কিছু গাণিতিক সমাধানের ব্যাপারে হার্ডি আগেই জানতেন। কয়েকটা সমাধানে ভুল খুঁজে পান। আর বাকি সব সমাধান একদম নতুন, আনকোরা। গণিতের জগতের কেউ এই সমাধানগুলো আগে দেখেনি।

রামানুজন পাঁচ বছর ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে হার্ডির সাথে গণিতের উপরে কাজ করেন। ১৯১৭ সালে তিনি ইংল্যান্ড ম্যাথম্যাটিক্যাল সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৮ সালে রয়াল সোসাইটিও তাঁকে সদস্য করে নেয়। ৩১ বছর বয়সী এই গণিতের ঈশ্বরই রয়েল সোসাইটির সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য।

গণিতের পেছনে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে অপুষ্টিতে ভুগতে শুরু করেন রামানুজন। তাছাড়া তিনি ছিলেন নিরামিষাশী। ইংল্যান্ডে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মন্দার বাজারে সবজি বেশ দুর্লভ হয়ে পড়ে। সেটার প্রভাবও পড়ে রামানুজনের শরীরের উপরে। সবজি না পেলে তিনি খাওয়ার চিন্তাই বাদ দিতেন। লেগে থাকতেন গণিত নিয়ে। এক পর্যায়ে স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে তাঁর। ১৯১৯ সালে তিনি ফিরে আসেন মাদ্রাজে। সেখানেই কিছুদিন বাদে মাত্র ৩২ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন গণিতের এই ঈশ্বর। অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে, ওপারে দেবী লক্ষ্মীর হয়তো একজন দেবতা গণিতবিদের বেশী জরুরি প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। তাই তাঁকে এভাবে অকালে ডেকে নেয়া!

দুর্ধর্ষতা রেটিং
ইনফিনিটি/১০।

রামানুজনকে ডাকা হয়- ‘The man who knew infinity’ নামে। তাঁর গাণিতিক আবিষ্কারগুলো এখন সমানে ব্যবহৃত হচ্ছে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানে, বিশেষত স্ট্রিং থিওরিতে। এই ব্যক্তির রেটিং ইনফিনিটি হতে ১ পয়েন্ট কম হওয়াও সমর্থনযোগ্য নয়।

……এবং আজীবন সম্মাননা পুরষ্কার (মতান্তরে ১০ টার সাথে ১ টা ফ্রি)


* ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল (১৮২০ – ১৯১০)*

কে ছিলেন তিনি?
দেবী ছিলেন। নিঃস্বার্থভাবে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন অপরের সেবা-শুশ্রূষায়। তিনি বিখ্যাত ‘দ্যা লেডি উইথ দ্যা ল্যাম্প’ নামে। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে আহত সৈনিকদের বয়ানে- তারা যখন রাত-বিরাতে ব্যারাকের হাসপাতালে শুয়ে কাতরাতো, তখন হঠাৎ দেখতো হাতে আলো নিয়ে দেবতুল্য এক নারী আহতদের বিছানায় বিছানায় যাচ্ছেন। সবার অবস্থা খুঁটিয়ে দেখছেন। সাথের সহকারী নার্সদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন রোগীর ব্যাপারে। তারপর আলোয় ঘেরা সেই নারী আবার হারিয়ে কোথায় যেন চলে যাচ্ছেন। আমাদের সবাই এই আলো হাতে নিয়ে ঘোরা নারীর ব্যাপারে জানলেও, অনেকেই জানেন না তিনি সেই আলো হাতে নিয়ে কোথায় আবার হারিয়ে যেতেন। সেটাই বলছি আজ।

Flor

কেন তিনি দুর্ধর্ষ?
ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল হচ্ছেন গণিতের জগতের দুর্ধর্ষ পরিসংখ্যানবিদ। আজকে পরিসংখ্যানে যেসব পাই চার্ট, কলাম ইত্যাদির মাধ্যমে সহজভাবে বিশাল সংখ্যক তথ্যের উপস্থাপনা দেখেন, সেসব পদ্ধতির আধুনিকায়ন করেছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল। নিজের পেশার সুবিধার্থেই তাঁকে এগুলো উদ্ভাবন করে নিতে হয়েছিলো।

তাঁর জন্মই হয়েছিলো অবশ্য এক উচ্চ শিক্ষিত ও অত্যন্ত আধুনিক মনস্ক পরিবারে। ১৮২০ সালে জন্ম নেয়া নাইটিংগেল ছোটবেলা হতেই গণিত, উদ্ভিদবিদ্যা এবং ভূ-গোলের উপরে শিক্ষালাভ করতে থাকেন। আট কি নয় বছর বয়সেই তিনি তাঁদের বাড়ির বাগানের সবগুলো ফল ও সবজির গাছ হতে লিখিত ডেটা জোগাড় করে সেগুলো নিয়ে পরিসংখ্যানের ছক দাঁড় করাতে পারতেন। গণিতের সংখ্যারা তাঁকে ঠিক সেভাবেই টানতো, যেভাবে আগুনের শিখা টানে পোকাদের। টিনেজ বয়সে তাঁর সাথে পরিচয় ঘটে চার্লস ব্যাবেজের। হ্যাঁ, অ্যানালিটিকাল মেশিনের উদ্ভাবক সেই চার্লস ব্যাবেজ! ব্যাবেজ নাইটিংগেলের সংখ্যার প্রতি আসক্তি দেখে বেশ পুলকিত হন। তাঁদের বাড়িতে বেড়াতে আসলে ব্যাবেজ পরিসংখ্যানের ব্যাপারে অনেকভাবেই সহায়তা করতেন কিশোর বয়সী সেই নাইটিংগেলকে।

ইংরেজি ভাষায় ১৭৯৮ সালে প্রথম ‘স্ট্যাটিস্টিকস’ শব্দটি ব্যবহার করেন স্কটিশ পরিসংখ্যানবিদ স্যার জন সিনক্লেয়ার। এরপর থেকেই গণিতের এই শাখাটা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের হর্তাকর্তা ও গণ মানুষের কাছে। কারণ শোচনীয় রকমের আই-কিউ বিশিষ্ট জনগণ ও হাস্যকর রকমের আই-কিউ বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের কাছে এটা ছিলো গণিত না বুঝেও প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো জেনে নেয়ার এক বিশেষ উপায়। পার্লামেন্টের মন্ত্রীরা এই সিস্টেমটাকে ব্যবহার করে জেনে নিতে লাগলেন তাদের রাষ্ট্রে জন্ম-মৃত্যুর হার, বেকারত্বের হার, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা, বিদেশী বাণিজ্যের অবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি।

"তার মানে বোঝাতে চাচ্ছো আমাদের দেশের অর্থনীতি খাড়া উপরে না উঠে এই তীরটার মতো ভেঙ্গে-চুরে কাত হয়ে পড়ে গেছে?" - জনৈক রাজনীতিবিদ

“তার মানে বোঝাতে চাচ্ছো আমাদের দেশের অর্থনীতি খাড়া উপরে না উঠে এই তীরটার মতো ভেঙ্গে-চুরে কাত হয়ে পড়ে গেছে?” – জনৈক রাজনীতিবিদ

১৮৫৩ সালে শুরু হয়ে যায় রাশিয়ায় ক্রিমিয়ার যুদ্ধ। ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ সিডনী হার্বার্টের অনুরোধে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলকে দায়িত্ব নিতে হয় ৩৮ সদস্য বিশিষ্ট নার্সের একটা দলের। তাদেরকে পাঠানো হয় তুরস্কে ‘ইংলিশ জেনারেল মিলিটারি হসপিটাল’-এ সেখানকার সৈনিকদের সেবা-শুশ্রূষা করার জন্যে। সেখানে গিয়ে নাইটিংগেলের চক্ষু চড়কগাছ! হাসপাতালের ঔষধ-পত্র দূরের কথা, প্রতিদিন আসা আহত সৈনিকদের সংখ্যার কোনো মা-বাপই খুঁজে পেলেন না তিনি। ঠিকমতো কোনো ডেটা রেজিস্টার করা হয় না। তাছাড়া হাসপাতালের দুর্গন্ধযুক্ত নোংরা পরিবেশ দেখেও বিষম খেলেন তিনি। পরে একটু সামলে উঠে সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে আসতে লাগলেন ফ্লোরেন্স। প্রতিদিন কী পরিমাণ সৈনিক আসছে যাচ্ছে, কী পরিমাণ ঔষধ-ব্যান্ডেজ ইস্যু করা হচ্ছে, প্রতি রোগীর বিপরীতে কতজন হাসপাতাল কর্মী আছে, পরিচ্ছন্ন কর্মী আছে, কয়টা চাদর-বালিশ-কম্বল আছে, কী পরিমাণ খাদ্য ও পানীয় আছে- তার সবকিছুরই পরিসংখ্যান চার্ট তৈরি করতে শুরু করলেন তিনি। মাত্র এক মাসেই হাসপাতালের ভোল পালটে গেলো। নিজের লেখা বইয়ে ফ্লোরেন্স উল্লেখ করেছিলেন, “সৈনিকেরা হয় যুদ্ধে মারা যেতো, আর না হয় এই হাসপাতালে এসে মারা যেতো”। শুধু তাই নয়। স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিয়েও কাজ করেছিলেন ফ্লোরেন্স। শুধুমাত্র নিরাপদ স্যানিটেশনের অভাবে যে মৃত্যুহার কত বেড়ে যাচ্ছে, সেটা চার্টের মাধ্যমে উপস্থাপন করে ইংল্যান্ডের মন্ত্রীদের কাছে পাঠিয়েছিলেন তিনি। তিনি এটা সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করতে যে পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছিলেন, সেটা এখন ‘নাইটিংগেল রোজ ডায়াগ্রাম’ নামে পরিচিত পরিসংখ্যানের জগতে। শুধু ক্রিমিয়ার যুদ্ধেই নয়, ভারতের স্যানিটেশন ব্যবস্থাও তিনি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের নজরে এনেছিলেন। ১৮৫৮ থেকে ১৮৭৩ সালে পর্যন্ত তিনি টানা ভারতের স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করে যান। নাইটিংগেলের দেয়া পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী শুধুমাত্র নিরাপদ স্যানিটেশনের অভাবে ভারতে মৃত্যুহার ছিলো প্রতি হাজারে ৬৯ জন। ফ্লোরেন্স ও ব্রিটিশ সরকারের মিলিত উদ্যোগের কারণে ১৮৭৩ সালে এই হার নেমে গিয়ে দাঁড়ায় প্রতি হাজারে ১৮ জনে।

তিনি প্রায় দু’বছর ধরে ব্যস্ত ছিলেন ‘Notes on Matters Affecting Health, Efficiency, and Hospital Administration of the British Army’ বইটা লেখার কাজে। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করার পর রাতে এই বই লিখতে বসতেন তিনি। বইয়ের নামে ‘নোট’ শব্দটা থাকলেও এটা স্রেফ কোনো নোট ছিলো না। মূলত এটা ছিলো সাড়ে আটশ পৃষ্ঠার একটা বই। রাতে চার ঘণ্টার মতো ঘুমাতেন তিনি। আর প্রদীপের আলোয় লিখতেন এই বই। লিখতে লিখতে ক্ষণে ক্ষণে প্রদীপ হাতে উঠে গিয়ে দেখে আসতেন তাঁর রোগীদের অবস্থা। রাউন্ড শেষ করে এসে বসে আবার লিখা শুরু করতেন এই বই।

১৮৮৩ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার নিকট হতে ‘রয়াল রেড ক্রস’ পদক পান ফ্লোরেন্স। ১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট এক সকালে লন্ডনের মেফেয়ারে নিজের বাড়িতে শুয়ে ছিলেন নাইটিংগেল। সকাল হবার পরেও তাঁর চাকরেরা ডাকাডাকি করে কোনো সাড়া না পাওয়ায় রুমে ঢুকে দেখে- শুধু ঘুম নয়, চিরনিদ্রায় তলিয়ে গেছেন আমাদের “আলো হাতে বয়ে নিয়ে চলা দেবী”। ৯০ বছর বয়সে ঘুমের মাঝেই নিশ্চিন্তে মর্ত্যলোক ত্যাগ করেন ফ্লোরেন্স, গণিত শাস্ত্রের দুর্ধর্ষ এক পরিসংখ্যানবিদ।

দুর্ধর্ষতা রেটিং
এক গণিতবিদ মারা যাবার পর স্বর্গে গেলেন। সেখানে তাকে একটা রুম দেখিয়ে বলা হলো- এই ঘরে আপনি থাকবেন। তবে আপনার সাথে আরো চারজন রুমমেট থাকবে।

প্রথমে একজনকে দেখিয়ে বলা হলো- ইনি আপনার রুমমেট। উনার আই-কিউ ১৮০।
গণিতবিদ বললেন- বাহ! উনার সাথে জমিয়ে গাণিতিক তত্ত্ব আলোচনা করা যাবে।

দ্বিতীয় একজনকে দেখিয়ে বলা হলো- ইনিও আপনার রুমমেট। উনার আই-কিউ ১৪০।
গণিতবিদের জবাব- বাহ! উনার সাথে সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে আলাপ করা যাবে।

তৃতীয় জনকে দেখিয়ে বলা হলো- এই ব্যক্তির আই-কিউ ১০০।
গণিতবিদ বললেন- দারুণ! সঙ্গীতের খুঁটিনাটি নিয়ে কথা বলার লোক পাওয়া গেলো একজন।

শেষের জনকে দেখিয়ে বলা হলো- উনার আই-কিউ ৫০।
গণিতবিদ মুচকি হেসে হ্যান্ডশেইক করে বললেন- কী খবর আপনার। সবে এলেন বুঝি। তা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন কেমন?

উপরের এই ফালতু জোকসের সাথে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের রেটিং-এর সম্পর্ক কী? কোনো সম্পর্ক নাই। উনি ‘আজীবন সম্মাননা’ পাওয়ায় রেটিং-এর আওতার বাইরে। তাছাড়া এমন এক ব্যক্তিকে রেটিং দেয়ার কোনো ইচ্ছেও নেই আমাদের!
অসংখ্য কৃতজ্ঞতা তাদের প্রতি, যারা দাঁতে দাঁত চেপে “সেরা দশ গণিতবিদ + একটা ফাও = গণিতের ওরা ১১ জন” বিষয়ক এই অখাদ্য সিরিজটা হজম করেছেন।

(সমাপ্ত)