নিকোলা টেসলা- হারিয়ে যাওয়া এক নাম

 প্রথমেই কয়েকটা বিজ্ঞানভিত্তিক কুইজ আপনাদের জন্যে। বলুন তো-

১। আমাদের পরিচিত এবং বাসাবাড়িতে বহুল ব্যবহৃত ফ্লুরোসেন্ট বাতির আবিষ্কারক কে?
২। আধুনিক জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আবিষ্কারক কে?
৩। আমরা এখন যে এক্স-রে ফটো প্রযুক্তি ব্যবহার করি এর নেপথ্য নায়ক কে?
৪। রেডিওতে যে অনবরত আর.জে. দের বকবকানি আর গান শুনছেন সেটার আবিষ্কারক কে?
৫। টিভিতে যে রিমোট কন্ট্রোল চেপে নিউজ চ্যানেল হতে খেলার চ্যানেল, খেলার চ্যানেল হতে ডকুমেন্টারি চ্যানেল, সেখান হতে মুভি চ্যানেল, আর সবশেষে মুভি চ্যানেল হতে মিউজিক চ্যানেলে গিয়ে নাচগান দেখছেন- সেই রিমোট কন্ট্রোল এর আবিষ্কারক কে?
৬। আধুনিক রোবটিক্স-এর প্রথম ধারণার সূত্রপাত কার হাত ধরে?
৭। ওয়ারলেস যোগাযোগ ব্যবস্থার সূত্রপাত কার হাতে?

প্রথমেই বলি আপনাদের জবাবগুলো-
১। ‘টমাস আলভা এডিসন’ কিংবা ‘পিটার কুপার হিউইট (Peter Cooper Hewitt)’
২। জর্জ ওয়েস্টিংহাউজ (না, ‘লেস্টার অ্যালান পেল্টন’ নন। তিনি জলবিদ্যুৎ শক্তি সম্পর্কিত ধারণা দেন। কিন্তু বর্তমানে আমরা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে যেভাবে চিনি সেটার আবিষ্কারক হিসেবে ধরা হয় জর্জ ওয়েস্টিংহাউজকে)
৩। উইলহেলম রন্টজেন
৪। গুইয়েলমো মার্কনি (Guglielmo Marconi)
৫। নিকোলা টেসলা
৬। প্রথম গ্রীক প্রকৌশলী টেসিবিয়াস (Ctesibius)-এর ২৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৈরিকৃত জলঘড়িকে প্রথম রোবটের নমুনা হিসেবে ধরা যায়। কিন্তু আধুনিক রোবট জনসম্মুখে প্রদর্শনের জন্যে উল্লেখ করা হয় ‘ডব্লিউ এইচ রিচার্ডস’ এর নাম, যিনি ১৯২৮ সালে লন্ডনে রিমোট কন্ট্রোলড রোবট সর্বপ্রথম প্রদর্শন করেন।
৭। নিকোলা টেসলা

এবার শুনুন আমাদের বিজ্ঞানযাত্রার জবাব –
১। নিকোলা টেসলা
২। নিকোলা টেসলা
৩। নিকোলা টেসলা
৪। নিকোলা টেসলা
৫। নিকোলা টেসলা
৬। নিকোলা টেসলা
৭। নিকোলা টেসলা

এবার আসি লাখ টাকার প্রশ্নে। সেটা হলো, আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ নিশ্চয়ই মনে মনে ভাবছেন- এই নিকোলা টেসলা আবার কে? আসলে যারা এই নাম বাবার জন্মেও শুনেননি তাদের এই নাম না জানার অপরাধ আমরা ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা ছাড়া কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছিনা। যারা বিজ্ঞানকে প্রকৃত ভালোবাসেন, নিকোলা টেসলা তাদের অনেকের কাছে মোটামুটি সুপারহিরো। কারো কারো কাছে তিনি ব্যাটম্যান- বিজ্ঞানের জগতের ‘দ্যা ডার্ক নাইট’।

যদি নোলানের ‘ডার্ক নাইট’ মুভির ‘কমিশনার গর্ডন’ এর ভাষায় বলি, তাহলে বলতে হয়-

“টেসলা হচ্ছে সেই হিরো বিজ্ঞানের যাকে প্রয়োজন, কিন্তু ঠিক এখনই তাকে বরনের জন্যে বিজ্ঞান প্রস্তুত নয়। তাই সঠিক সময়ের আগ পর্যন্ত আমরা তাকে উপেক্ষা করবো, কিন্তু তার এতে কিছুই আসবে যাবে না। কারণ সে শুধু আমাদের হিরো নয়। সে হচ্ছে বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ সাধক, নিঃশব্দ রক্ষাকর্তা। দ্যা ডার্ক নাইট!” (এখানে ‘হ্যান্স জিমার’ এর কম্পোজ করা এপিক মিউজিক বাজা শুরু হবে)

নাটক করা বাদ দিয়ে মূল ঘটনায় যাই। বস্তুতপক্ষে, আপনি দৈনন্দিন জীবনে প্রায় সবক্ষেত্রেই টেসলার কোনো না কোনো অবদান ব্যবহার করছেন। এমনকি এই যে ইন্টারনেটে বসে আপনার জীবনের মূল্যবান সময়গুলো ফেইসবুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করছেন, এর পেছনেও আছে টেসলার অবদান। ভাবছেন- কী করে, তাই তো? আসলে আপনি যে আপনার কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল ইত্যাদি চালাতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন সেটা টেসলারই অবদান! আপনার রুমে যে বাতি জ্বলছে সেটা টেসলার অবদান। এফ এম রেডিওতে যে আর.জে. দের বাংলিশ (আর.জে.দের সবাই অবশ্য এমন বাংলিশ ভাষায় কথা বলেন না) কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে গান শুনছেন- সেটার পেছনেও টেসলা।

এতক্ষণে আপনাদের অনেকেই হয় চোখ কপালে তুলে ফেলেছেন, না হয় মনে মনে ভাবছেন- আমরা গাঁজার কল্কে হাতে নিয়ে এই লেখাটা লিখতে বসেছি। আপনার রাগ আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু একটু সবুর করুন। আগে চলুন মূল লেখাটা পড়ি-

নিকোলা টেসলাঃ ম্যাড সায়েন্টিস্ট

নিকোলা টেসলার জন্ম ১৮৫৬ সালে। তিনি জন্মসূত্রে সার্বিয়ান। কিন্তু পুরো শৈশব ও কৈশোর কাটিয়েছেন ক্রোয়েশিয়ায়। এ কারণে সার্বিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া আজও টেসলাকে নিয়ে টানা হেঁচড়া করে, বিতর্ক করে- তিনি আসলে কাদের? বিতর্কের মূল কারণ সেই সময় দুটো এলাকাই অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। যা পরে ভেঙ্গে সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে পরিণত হয়। তার পিতা ছিলেন একজন যাজক।

১৮৮০ সালে টেসলা পকেটে করে মাত্র চার পেনি (ডলার নয়, পেনি!), একটা কাগজে লেখা কয়েক গুচ্ছ কবিতা, আর একটা বিমান বানানোর ব্লু-প্রিন্ট (যা আর কখনো বানানো হয়ে ওঠেনি) নিয়ে আমেরিকায় পা রাখেন। এর ঠিক ২০ বছরের মধ্যে টেসলা বলতে গেলে প্রায় একাই বৈদ্যুতিক নানাবিধ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটান। তার হাত ধরেই আসে-

*বৈদ্যুতিক জেনারেটর (মূলনীতি মাইকেল ফ্যারাডের হলেও ব্যবহারিক আবিষ্কার টেসলার)
*রেডিও
*রিমোট কন্ট্রোল
*স্পার্ক প্লাগ
*রোবট (জ্বি হ্যাঁ, রোবট!)
*ফ্লুরোসেন্ট বাতি (যেটার ক্রেডিট পরে ‘এডিসন’ নিয়ে নেন)
*টেসলা কয়েল (টিভি, রেডিও দুটোরই অপরিহার্য অংশ) ………এবং আরও অনেক কিছু যা এই বিংশ শতাব্দীতে আপনার জীবনকে পুরোই বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে।

উপরের তালিকার অনেকগুলো হয়তো আপনারা চিনবেন। আর যারা ‘কমান্ড এন্ড কংকার- রেড এলার্ট’ ভিডিও গেইম সিরিজের ভক্ত, তারা ভালোমতোই জানেন টেসলা কয়েল কী! যদিও এর উৎপত্তির পেছনে অসাধারণ গল্প অনেকেই জানেন না। (জ্বি হ্যাঁ, টিভি-রেডিওর উপাদান ‘টেসলা কয়েল’ দিয়ে বাস্তবিক ভাবেই বিশাল টাওয়ার বানিয়ে সেটা দিয়ে আমেরিকা কিংবা ব্রিটেনের সৈন্যদেরকে ভাজা ভাজা করে আপনার সোভিয়েত মিলিটারি বেইজ রক্ষা করা সম্ভব!)

বিভিন্ন সায়েন্স ফিকশন গল্পে বা মুভিতে ‘ম্যাড সায়েন্টিস্ট’ বলতে যা বোঝায়, ঠিক তাই ছিলেন নিকোলা টেসলা। তিনি ছিলেন চিরকুমার। জ্যামিতিক ভাবে নিখুঁত গোলাকার বস্তুর প্রতি অদ্ভুত এক আতংক ছিলো তার (কে জানে, তিনি হয়তো এ কারণেই চিরকুমার ছিলেন)! তদুপরি কোনো সংখ্যা, বা বস্তু যা সুষমভাবে তিন ভাগ করা যায় না সেগুলোর প্রতিও আজব এক ভীতি ছিলো তার

তিনি একদা মিডিয়ার সামনে জোর গলায় দাবি করেছিলেন তিনি ‘ভয়ংকর মৃত্যু রশ্মি’ আবিষ্কার করেছেন। কেউ তার কথা বিশ্বাস করেনি। হাসাহাসি করেছিলো।

টেসলা তার সারা জীবনে কোনো আবিষ্কারের জন্যই কৃতিত্ব পাননি। বরং তার মৌলিক আবিষ্কার চুরি করে- ডিজাইন একটু এদিক সেদিক করে কিংবা সামান্য উন্নত সংস্করণ তৈরি করে অনেকেই ইতিহাসের পাতায় নাম কামিয়েছেন। টেসলার বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার বাইরে বাকি সারা জীবন ব্যয় হয়েছে এইসব চুরি হওয়া আবিষ্কারের পেটেন্ট নিয়ে কোর্টে লড়াই করতে কিংবা তার বেঁচে থাকার খরচ জোগাতে। তার উন্মাদ সব গবেষণা নিয়ে সবাই হাসাহাসি করতো। কিন্তু ১৯৪৩ সালে যখন টেসলা সম্পূর্ণ নিঃস্ব-হত-দরিদ্র অবস্থায় মারা যান, তখন ঠিকই তৎকালীন এফবিআই চীফ ‘জে. এডগার হুভার’ আরও কিছু এফবিআই সদস্য নিয়ে টেসলার হোটেল রুমে হামলা চালিয়ে তার সুটকেস এবং সমস্ত কাগজ-পত্র লুটপাট করে। সেইসব কাগজ-পত্রের হদিস আজও পাওয়া যায়নি। এগুলো এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমেরিকা সরকার অত্যন্ত সুরক্ষিত ভল্টে জব্দ করে রেখেছে। ষড়যন্ত্র তত্ত্ববিদেরা অভিযোগ করেন টেসলার অনেক আইডিয়া মানব কল্যাণে না লাগিয়ে তারা গোপন বিধ্বংসী গবেষণায় কাজে লাগাচ্ছে। টেসলার অনেক আবিষ্কার এখন আমাদের কাছে ডাল-ভাত ব্যাপার। তবু কেন এত নিরাপত্তা? তাহলে কি টেসলার বৈজ্ঞানিক গবেষণার সেসব কাগজ-পত্রে আরও কিছু আইডিয়া আছে যা আমরা এই একবিংশ শতাব্দীর মানুষ এখনো পাইনি?

টেসলা যে আসলে ১৫০ বছর আগের মানুষ না, বরং আমাদের এই যুগের মানুষ সেটার প্রমাণ পাবেন যখন আমরা উল্লেখ করবো, তিনি একবার বলেছিলেন, “এমন এক সময় আসবে যখন সংবাদ, প্রেসিডেন্টের ভাষণ, কিংবা মাঠের খেলাগুলো তারবিহীন পদ্ধতিতে ঘরে বসেই দেখা যাবে”। হ্যাঁ, টেসলার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। টিভি এবং ইন্টারনেটের ভুবনে সবাইকে স্বাগতম!

বৈদ্যুতিক যুদ্ধ

১৮৮৪ সালে নিকোলা টেসলা টমাস আলভা এডিসনের কোম্পানিতে চাকুরী নেন। সেইসময় তিনি এডিসনকে বলেন যে এডিসনের ফ্লুরোসেন্ট বাতি নিয়ে বৈদ্যুতিক গবেষণার কাজ অনেক তাড়াতাড়ি এবং আরও কম খরচে তিনি শেষ করতে পারবেন। এডিসন প্রস্তাব দেন যদি টেসলা এটা করতে পারে তবে তাকে ৫০,০০০ ডলার পুরষ্কার দেয়া হবে

এখানে টমাস আলভা এডিসন সম্পর্কে একটু বলা প্রাসঙ্গিক। এডিসন ছিলেন বিত্তশালী এবং একটা কর্পোরেশনের মালিক। ইতিহাস এডিসনকে কতটা ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে তা বুঝবেন যদি জানেন যে এডিসনের মানসিকতা ছিলো বর্তমানে পুঁজিবাদ সমাজের বড় বড় মুনাফা-লোভী কর্পোরেশনের মালিকদের মত। তিনি দরিদ্র-অসহায় কিন্তু মেধাবী বিজ্ঞানীদের দুঃস্থতাকে কাজে লাগিয়ে টুপাইস কামানোর সাথে সাথে বিজ্ঞানের জগতেও নিজেকে একজন কেউকেটা হিসেবে স্থাপন করেছিলেন। এরা সবাই তার হয়ে কাজ করতো। যখন ভালো কোনো আইডিয়া তার নজরে আসতো সেটার স্বত্ব তিনি কিনে নিতেন। তারপর নিজের নামে চালিয়ে দিতেন। যারা বিক্রি করতে চাইতো না, তাদের সাইজ করার জন্য এডিসনের ছিলো নিজস্ব ‘ঠেঙ্গাড়ে’ বাহিনী! শুধু তাই নয়, আমেরিকার ফিল্ম ইতিহাসে প্রথম যুগের মুভি পাইরেসিতে জড়িতদের একজন ছিলেন এডিসন। ফরাসি ফিল্ম নির্মাতা ‘জর্জেস মিলিয়েস (Georges Méliès)’-এর মতো বিদেশী প্রতিভাবানদের তৈরি ফিল্মের নেগেটিভ কপি আমেরিকাতে পাচার করে এনে পরে সেগুলোর ডুপ্লিকেট কপি বানিয়ে আমেরিকাতে প্রদর্শন করতেন এডিসন এবং তার গ্যাং। সেই প্রদর্শনীর মুনাফার অংশের এক পয়সাও পেতেন না বিদেশী এই ফিল্ম নির্মাতারা। এক পর্যায়ে মিলিয়েস তাঁর ফিল্ম প্রোডাকশন হাউজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন লাভের দেখা না পেয়ে। মার্টিন স্করসেজির ‘হুগো’ নামে অনবদ্য এক সিনেমা আছে ফিল্ম নির্মাতা মিলিয়েজের উপর ভিত্তি করে। যাই হোক, এডিসনের এই গ্যাং আমেরিকান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে শক্তিশালী এক সিন্ডিকেটও গড়ে তুলেছিলো। নিয়ম করেছিলো- এই সিন্ডিকেটের অনুমতি ব্যতীত কেউ কোনো ফিল্ম নির্মাণ, আমদানি এবং প্রদর্শন করতে পারবে না আমেরিকায়। ফলতঃ সিনেমা নির্মাণ এবং প্রদর্শনে বিশাল এক লাভের গুড় এরাই খেয়ে ফেলতো। যারা এর অন্যথা করতো, তাদের জন্যে ছিলো যথারীতি ঠেঙ্গাড়ে বাহিনী। এই গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক স্বাধীনচেতা ফিল্ম নির্মাতা পরে পাড়ি জমান ক্যালিফোর্নিয়ায়। আর সেখানেই পরে কালান্তরে প্রতিষ্ঠিত হয় আজকের চেনাজানা হলিউড। আমেরিকান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মূল ভিত্তি ক্রমান্বয়ে নিউইয়র্ক হতে সরে চলে আসে ক্যালিফোর্নিয়ায়। আমরা জানি, কারো কারো এসব কথা বিশ্বাস হবে না। তাই আমাদের কথা বিশ্বাস না হলে ইন্টারনেটে একটু খোঁজ করে দেখুন।

যাই হোক, আমরা এডিসনকে এক্কেবারে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি না। বৈদ্যুতিক বাতি সংক্রান্ত কিছু গবেষণা তার আসলেই ছিলো। কিন্তু সেটা কার্যকরী ছিলো না। প্রথম কার্যকরী এবং সাশ্রয়ী ফ্লুরোসেন্ট বাতি ছিলো নিকোলা টেসলার। পেটেন্ট অফিসের তথ্য অনুযায়ী এডিসনের নামে প্রায় ১০০০ আবিষ্কারের তালিকার প্রায় সবকটাই হয় অন্যের কাছ থেকে টাকা দিয়ে কেনা, নাহয় গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে ঠেঙ্গিয়ে কেড়ে নেয়া ‘ব্লু-প্রিন্ট’ এর ফসল।

যাই হোক, টেসলার প্রসঙ্গে আসি। উপরোক্ত প্রতিশ্রুতি প্রদানের পর টেসলা মাস কয়েক ক্রীতদাসের মত খেটে তার প্রজেক্ট শেষ করলেন এবং ফ্লুরোসেন্ট বাতিকে আমরা বর্তমানে যেভাবে চিনি সেভাবে রূপদান করলেন। তারপর যখন এডিসনের কাছে তার প্রাপ্য পুরষ্কার চাইতে গেলেন এডিসন তখন বেশ একচোট হেসে পাক্কা ভিলেনের মত বললেন, “লুলজ! আপনি তো দেখি আমেরিকান রসিকতাও বুঝেন না।”

টেসলা তখন ক্ষেপে গিয়ে এডিসন কোম্পানির চাকুরী ছেড়ে দেন। এই সুযোগে তাকে লুফে নেয় এডিসনের প্রতিদ্বন্দ্বী ‘ওয়েস্টিংহাউজ ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি‘ (নামটা খেয়াল রাখুন)। কিছুদিনের ভেতরেই শুরু হয়ে যায় বৈদ্যুতিক যুদ্ধ। একদিকে এডিসনের স্থির বিদ্যুৎ (ডিসি কারেন্ট) বনাম অন্যদিকে ওয়েস্টিংহাউজের সাথে মিলে টেসলার চলবিদ্যুৎ (এসি কারেন্ট)। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটা ‘বৈদ্যুতিক যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এই পর্যায়ে আমরা পরামর্শ দিচ্ছি ঐতিহাসিক এই দুর্ধর্ষ যুদ্ধের উত্তেজনা পুরোপুরি আঁচ করার জন্য ব্যাকগ্রাউন্ডে আপনারা ফুল ভলিউমে ‘এসি/ডিসি’ ব্যান্ডের কোন মিউজিক ছেড়ে দিন। আমরাও লেখাটা লিখার সময় তাই করেছি!

যাই হোক, শেষ পর্যন্ত টেসলার তত্ত্বই ঠিক হলো। তার চলবিদ্যুৎ এডিসনের স্থির বিদ্যুতের চেয়ে বেশী কার্যকরী প্রমাণিত হলো। টেসলার চলবিদ্যুৎ আবিষ্কার না হলে আমাদের হয়তো আজকে এডিসনের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হতো যেখানে প্রত্যেক ঘরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হলে আলাদা আলাদা জেনারেটর বসানো লাগতো। কিন্তু টেসলার প্রযুক্তি অনুযায়ী এখন বহু মাইল দূরে একটা পাওয়ার স্টেশনে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় এবং সেখান থেকে তার দিয়ে টেনে বাসা-বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।

কিন্তু টেসলা দুর্ধর্ষ বৈজ্ঞানিক হলেও যেহেতু তেমন মেধাবী ব্যবসায়ী ছিলেন না, তাই শেষ পর্যন্ত হারু পার্টির খাতায় নাম লেখালেন টেসলা-ই। তার সমস্ত গবেষণার ফসলই এখন ব্যবহৃত হচ্ছে আপনার পকেটের টাকা দিয়ে এডিসনের উত্তরসূরীদের পকেট বোঝাই করতে।

টেসলাকে অনেকে চেনে একটা কাল্পনিক চরিত্র হিসেবে। ক্রিস্টোফার প্রিস্টের লেখা সায়েন্স ফিকশন The Prestige এর মধ্যে টেসলা আর এডিসনকে নিয়ে আসা হয়েছিলো। বইটিকে কেন্দ্র করে একটা চলচ্চিত্রও (দ্যা প্রেস্টিজ– ২০০৬ এর চলচ্চিত্র) বানিয়েছেন খ্যাতনামা পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান। ওখানে আসলে গল্পের প্রয়োজনেই টেসলাকে নিয়ে আসা হয়েছিলো। কাহিনীর নায়ক রবার্ট এনজিয়ার এমন একটা ক্ষমতা খুঁজছিলো, যা বাস্তবে নেই। আর পৌরাণিক কোনো ক্ষমতাকে বাস্তব করে তোলার ক্ষমতা ইতিহাসে খুব বিজ্ঞানীর কাছে ছিলো না। যাদের ছিলো, তাদের মধ্যে একজন নিকোলা টেসলা। যদিও সিনেমাতে দেখানো সেই আবিষ্কারটা হয়তো টেসলা করেননি; তবুও আমরা ক্রিস্টোফার প্রিস্ট আর ক্রিস্টোফার নোলানের কাছে কৃতজ্ঞ – এডিসন এবং তার ঠেঙ্গাড়ে বাহিনীকে সঠিকভাবে উপস্থাপনের জন্য।

টেসলার যা কিছু অবদান

টেসলার নামে ২৬টা দেশে প্রায় ৩০০ আবিষ্কারের পেটেন্ট রয়েছে। এর মধ্যে কিছুতো উপরেই উল্লেখ করা হয়েছে। আরও কিছু আবিষ্কারের মধ্যে আছে- বৈদ্যুতিক ঝাড়বাতি, এক্স-রে মেশিনের যন্ত্রপাতি, বাইফিলার কয়েল, ব্লেড বিহীন টারবাইন।

বিজ্ঞানের জগতে বৈদ্যুতিক বাতির পাশাপাশি আরেকটা আবিষ্কার হচ্ছে ‘রেডিও’ যেটা নিয়ে তৎকালীন বিজ্ঞানী সমাজে ব্যাপক মাথা ফাটাফাটি এবং ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়েছিলো। জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, আলেক্সান্ডার পোপভ, স্যার অলিভার লজ, হাইনরিখ হার্জ, জগদীশ চন্দ্র বসু সহ অনেকেই এই রেডিও আবিষ্কার নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রেডিওর আবিষ্কারের পেছনে মার্কনি’র নাম টিকে গেলো। কিভাবে? সেই গল্পেই যাচ্ছি।

মার্কনি প্রথম রেডিও সিগন্যাল সম্পর্কে জানেন যখন তিনি ১৮৯৪ সালে ছুটি কাটানোর সময় বিজ্ঞানী হার্জের লেখা গবেষণাপত্রগুলো পড়েন। অথচ তার আরও ৭-৮ বছর আগে হতেই জগদীশ চন্দ্র বসু এবং নিকোলা টেসলা এই রেডিও সিগন্যাল নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলেন। মার্কনি প্রথম যে রেডিও সিগন্যাল আবিষ্কার করেছিলেন সেটা তার বাড়ির চিলেকোঠা পর্যন্ত পৌঁছেছিলো। পক্ষান্তরে ১৮৯১ সালেই টেসলার আবিষ্কৃত রেডিও সিগন্যাল সেকেন্ডে ১৫,০০০ সাইকেল বা চক্র সম্পন্ন করতে পারতো। কারণ এই কাজে তিনি ব্যবহার করেছিলেন তাঁর নিজেরই আবিষ্কৃত টেসলা কয়েল।

মার্কনি যখন ১৯০০ সালে তার রেডিওর মডেল নিয়ে যান পেটেন্ট অফিসে, তখন তাকে সোজা রাস্তা মাপতে বলা হয়েছিলো। কারণ পেটেন্ট অফিসের অভিযোগ ছিলো মার্কনি মূলত টেসলার রেডিওর মডেল এবং যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে সেটাকে নিজের মত সাজিয়ে নিয়ে এসেছেন। এরপরে ১৯০৪ সালে মার্কনি তার মডেল নিয়ে আবার পেটেন্ট অফিসে গেলে তারা কোন এক বিচিত্র কারণে টেসলার নাম কেটে দিয়ে মার্কনির নামে রেডিও পেটেন্ট ইস্যু করেন। তৎকালীন অনেক প্রত্যক্ষদর্শীদের লেখা থেকে জানা যায় মার্কনি এই সময়ে ক্ষমতাধর কিছু মানুষের সাথে উঠাবসার ফলে তাদের সংস্পর্শে চলে এসেছিলেন।

অন্যদিকে ঠিক একই সময়ে আমরা টেসলার দিকে তাকাই। তিনি ওয়েস্টিংহাউজ কোম্পানির সাথে মিলে চল বিদ্যুতের সাশ্রয়ী উৎপাদন কিভাবে সম্ভব সেটা আবিষ্কার করেন। টেসলাই সর্বপ্রথম নায়াগ্রা জলপ্রপাতের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাসা-বাড়িতে ব্যবহারযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হন। তার হাত ধরেই বিশ্ব পরিচিত হয় ‘আধুনিক জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র’ এর ধারণার সাথে। কিন্তু আমরাতো জানি ‘জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র’ এর আবিষ্কারক জর্জ ওয়েস্টিংহাউজ। উপরে বলেছিলাম যে মনে আছে, টেসলা এডিসনের কোম্পানি ছেড়ে ওয়েস্টিংহাউজ কোম্পানিতে চলবিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে গবেষণার কাজ নিয়েছিলেন। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কার মেধা বিক্রি করে ওয়েস্টিংহাউজ এই নাম কামিয়েছেন। ঘটনা এখানেই শেষ হলে ভালো ছিলো। কিন্তু হয়নি।

Tesla_colorado
এডিসন দেখলেন তার ‘ডিসি কারেন্ট’ টেসলার ‘এসি কারেন্টে’র কাছে ভোক্তাবাজারে বড় ধরণের মার খাবে। তাই তিনি প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগলেন যে– টেসলার তৈরি বিদ্যুৎ নিরাপদ নয়। বরং এতে জীবনহানি ঘটা সম্ভব। সেটা প্রমাণে তিনি জনসম্মুখে একটা সার্কাসের হাতিকে এসি কারেন্ট ব্যবহার করে শক দিয়ে মারেন। শুধু তাই নয়, তৎকালীন ‘গ্যারি কমিশন’ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের বদলে বিকল্প কিছু খুঁজছিলো। এডিসন সুযোগ বুঝে টেসলার এসি কারেন্টকে ব্যবহার করে চেয়ারে বসিয়ে অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড প্রদানের প্রস্তাব করেন। এমনকি মানবজাতির কল্যাণার্থে(!) ফাঁসির মত ভয়ংকর শাস্তির বিকল্প হিসেবে এই মহান বিজ্ঞানী এডিসন নিজ খরচে এবং নিজ উদ্যোগে এমন একটা চেয়ারও প্রস্তুত করে দেন। ১৮৮৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর জোসেফ শ্যাপ্লো (Joseph Chappleau) নামক এক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীকে এই চেয়ারে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের মাধ্যমে মানবসভ্যতায় এক নবদিগন্তের সূচনা হয়। ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের মত মানবতার প্রশ্নের সমাধান করে মানবজাতিকে বিবেক যন্ত্রণা হতে মুক্তি দেন এডিসন। একইসাথে সবার সামনে প্রমাণ করেন টেসলার চলবিদ্যুৎ কতটা ভয়ংকর।

পরে অবশ্য ইতিহাসে উল্লেখ না করার মত অতি ‘অগুরুত্বপূর্ণ’ কিছু ঘটনা ঘটে। যেমন- ওয়েস্টিংহাউজের ব্যবসায় লস খেতে থাকা, টেসলার গবেষণার মাধ্যমে এসি কারেন্টকে আরও উন্নত করে তোলার পেছনে টাকার অভাব দেখা দেয়া, ‘জে পি মরগান’ কর্তৃক ওয়েস্টিংহাউজ কোম্পানির শেয়ার ক্রয় এবং সর্বোপরি জে পি মরগানের মাধ্যমে ‘এডিসন ল্যাম্প কোম্পানি’র ‘ওয়েস্টিংহাউজ ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি’কে কিনে নিয়ে তাদের ডিসি কারেন্ট ব্যবসাকে এসি কারেন্ট ব্যবসাতে রূপান্তর করা।

শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো সবাই যে যা চেয়েছে তাই পেয়ে খুশি, কিন্তু সবার কাছে ভিলেন হয়ে গেছেন নিকোলা টেসলা। অভিজাত সমাজে তাঁর নাম কেউ শুনতে পারতেন না। ফলে, ১৯০৪ সালে পেটেন্ট অফিস তাঁর নাম কেটে দিয়ে রেডিওর পেটেন্ট মার্কনির নামে ইস্যু করাটাতে বিচিত্র কিছু খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। টেসলাকে এই ব্যাপারে বলা হলে তাঁর জবাব ছিলো, “মার্কনি ছেলেটা ভদ্র। সে যা করছে করতে দাও। সে ইতোমধ্যে আমার ১৭টা পেটেন্ট নিজের বিভিন্ন আবিষ্কারে ব্যবহার করেছে”।

কিন্তু পরে আবার ১৯৪৩ সালেই আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট রেডিওর পেটেন্টে ইতালিয়ান বিজ্ঞানী মার্কনি’র নাম বাতিল করে দিয়ে নিকোলা টেসলার নাম ঘোষণা করেছিলো। কিন্তু ততদিনে নিকোলা টেসলা মৃত।

যাই হোক, এছাড়াও টেসলার ময়লা, ব্যাকটেরিয়া, জীবাণুর বিরুদ্ধে বাতিক ছিলো। এই বাতিক থেকে টেসলা এমনকি একবার মানুষের শরীরের ময়লা-জীবাণু পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে বাথটাবও আবিষ্কার করেছিলেন, যাতে মানুষ গোসল করতে পানির বদলে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে!

তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনা হলো তিনি একবার বিশাল সাইজের টেসলা কয়েল দিয়ে ১৩০ ফুট দৈর্ঘ্যের বৈদ্যুতিক রশ্মি তৈরি করেছিলেন (‘কমান্ড এন্ড কংকার’ এর ভক্তরা পুনরায় স্বাগতম)! এটা এখন পর্যন্ত বিশ্ব রেকর্ড হয়ে আছে। তদুপরি তিনি একবার নিউ ইয়র্কে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টির জন্য দায়ী ছিলেন। এই ভূমিকম্পে নিউ ইয়র্কের ফিফথ এভিনিউ পুরোপুরি ধসে গিয়েছিলো!

উইলহেলম রন্টজেন প্রথম এক্স-রে রশ্মি আবিষ্কার করলেও সেটা দিয়ে যে ফটো তোলা সম্ভব সেটা দেখিয়েছেন নিকোলা টেসলা। ১৮৯৪ সালের দিকে তাঁর ল্যাবরেটরিতে বেড়াতে আসেন লেখক ‘মার্ক টোয়েন’। টেসলা তাঁর এই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর আগমন উপলক্ষে ভ্যাকুয়াম টিউবে কিছু ফটো তোলেন। কিন্তু পরে দেখা যায় ছবিতে মার্ক টোয়েনের খোমার বদলে ভ্যাকুয়াম টিউবের লেন্স অ্যাডজাস্ট করার স্ক্রুগুলো দেখা যাচ্ছে। সেখান হতেই তাঁর এক্স-রে ইমেজ নিয়ে গবেষণার শুরু। অন্যান্য সব ক্ষেত্রের বিপরীতে এই ক্ষেত্রে অবশ্য রন্টজেন টেসলাকে কৃতিত্ব দিয়েছিলেন তাঁর আবিষ্কৃত এক্স-রে রশ্মির এমন একটা ভালো উপযোগিতা খুঁজে বের করার জন্যে।

১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে নিকোলা টেসলা (মাঝখানে, ঝাপসা হয়ে গেছেন পুরো) তাঁর ল্যাবে লেখক মার্ক টোয়েন (বাঁয়ে) এবং অভিনেতা জোসেফ জেফারসন-এর (ডানে) সাথে।

 

টেসলার আবিষ্কারের মধ্যে আরও আছে ভ্যাকুয়াম টিউব, রোটারি ইঞ্জিন, লাউডস্পিকার, ওয়ারলেস যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাডার প্রযুক্তি ইত্যাদি।

চোখ নিশ্চয়ই এতক্ষণে কপালে উঠে গেছে। উঠারই কথা। নিকোলা টেসলা বলতে গেলে একাই বিংশ শতাব্দীর পরিচিত সব প্রযুক্তি আবিষ্কার করে গেছেন। পরবর্তীতে ইতিহাসের পরিচিত বিজ্ঞানীরা এগুলোকে সংস্কার করে আরেকটু উন্নত করেন এই আর কি। কিন্তু নিকোলা টেসলার মত সম্পূর্ণ মৌলিক চিন্তাধারা এবং প্রায় শূন্য হতে ম্যাজিকের মত কোন আইডিয়া নিয়ে আসা কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি।

উপরন্তু তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবদের মতে টেসলা একজন দুরন্ত কবি, আটটি ভাষায় কথা বলতে পারদর্শী এবং একবার কোন বই পড়লে সেই বই পুরোটা মগজে গেঁথে ফেলতে সক্ষম।

টেসলাঃ ভুলে যাওয়া এক প্রতিভা

আমরা যে বলেছিলাম ১৯৪৩ সালে টেসলা মারা যান, মনে আছে? সে ব্যাপারেই এখন আসছি। ১৯৪৩ সালের ৬ই জানুয়ারিতে টেসলা বৃদ্ধ বয়সে, সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থায় নিউইয়র্কের এক হোটেল রুমে মারা যান। কেউ কেউ বলেন, জার্মান নাজি গুপ্তচরেরা তাকে খুন করেছিলো। অনেকে দাবি করেন যে তারা গুপ্তচরদের নামও নাকি জানেন – অটো স্করজেনি (হিটলারের সরাসরি বডি গার্ড) এবং রাইনহার্ড। মৃত্যু যেভাবেই হোক না কেন, টেসলার যাবতীয় কাজকর্মের নকশা সব চলে যায় এফবিআইয়ের কাছে।

টেসলা চাইছিলেন মানবসভ্যতার উন্নয়নের জন্যে বিদ্যুৎশক্তিকে বিনামূল্যে ছেড়ে দেয়া হোক। তিনি অনেক প্রভাবশালীদের নিয়ে এ ব্যাপারে আলোচনাও করেছিলেন। কিন্তু কেউই তাঁর এই মতামত গ্রহণ করেননি। সবাই চেয়েছিলেন মানুষ বিদ্যুৎ তাদের থেকে কিনে নিয়ে ব্যবহার করুক। পরে টেসলা একা একাই গবেষণার মাধ্যমে এই লড়াই চালিয়ে যান। এতে কিছু সফলতাও লাভ করেন। তথ্য-প্রমাণ না থাকলেও অনেকে সন্দেহ করেন এই ব্যাপারটা নিয়ে গবেষণা করার কারণেই তিনি পুঁজিবাদীদের রোষানলে পড়ে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর পরপরই তাঁর হোটেল রুমে তৎকালীন এফবিআই চীফ এডগার জে হুভার এর নেতৃত্বে কিছু এফবিআই সদস্য হামলা চালায়। তারা টেসলার সব গবেষণাপত্র লুটপাট করে কেটে পড়ে।

আসলে শুধু মৃত্যুর পরে নয়, মৃত্যুর আগেও এই সমস্যাটায় তাকে পড়তে হয়েছিলো। তিনি যেটাই আবিষ্কার করেন সেটাই পরে চুরি হয়ে যায়। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও তার এমন অনেক আবিষ্কার বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে গিয়েছিলো। তার প্রযুক্তি দিয়ে অনেক দেশ সুপার পাওয়ার হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত টেসলা যেই নিঃস্ব-ভবঘুরে-হতচ্ছাড়া ছিলেন, তাই রয়ে গেলেন। মাঝে অনেক টাকা কামালেও সেগুলোকে নতুন গবেষণায় উড়িয়ে দিয়েছিলেন টেসলা।

এক জীবনে অনেক কিছুই দিয়েছিলেন টেসলা মানবসভ্যতাকে। কিন্তু তার থেকে পাবার কথা ছিলো আরো অনেক কিছু। যেমন- তার মৃত্যুর আরো ৮০ বছর পরে বিজ্ঞানীরা জানান, টেসলার সেই তারহীন পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রযুক্তি আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে অনেকটাই আছেন তারা। শতবর্ষ আগে টেসলার যে ধারণাটাকে হেসে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলো সভ্যতা, এখন সেটাই আবার তেলে-জলে ঘোল খেয়ে আবিষ্কারে ব্যস্ত তারা। দুর্দান্ত প্রতিভার সাথে সাথে একটু জটিল ব্যবসায়িক বুদ্ধি না থাকায় তার সময়ে হেরে গিয়েছিলো বোকা মানুষটা!

এইবার একটা লাখ টাকার প্রশ্ন। যদি টেসলা এতই জিনিয়াস হয় তাহলে বিশ্ববাসী তার সম্পর্কে এত কম জানে কেন? কেন স্কুলে এডিসন, মার্কনি, কিংবা আইনস্টাইনের নামের সাথে সাথে তার নাম জানলাম না?

এর কারণ টেসলা সম্পর্কে আমাদের কখনো জানতে দেয়া হয়নি। তার আবিষ্কারগুলো ছিলো বিভিন্ন দেশের সরকারের বেশ আগ্রহের বিষয়। তার সমসাময়িক সকল বিজ্ঞানীরা তার অনন্য মেধাকে হিংসা ও ঘৃণা করতেন। কিন্তু তার কাছ থেকে আইডিয়া চুরি করতে কারো তেমন খারাপ বোধ হতো না। কিন্তু টেসলা প্রশংসা দূরে থাক, বেঁচে থাকার জন্য ভালোমতো খাবারের পয়সাই জোটাতে পারেননি। তিনি এমনকি আক্ষেপ করে বলেছিলেন- কিছু টাকাপয়সার মালিক হলে তিনি আরও নতুন নতুন কিছু আইডিয়া নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারতেন। এবার কল্পনা করুন বিদ্যুৎ, রেডিও, টিভি, ওয়ারলেস ফোন, রাডার, এক্স-রে মেশিন, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ১৩০ ফুট লম্বা বৈদ্যুতিক রশ্মির বাইরেও আর কি আবিষ্কার তিনি আমাদের উপহার দিতে পারতেন? আমরা একটু বেশি কল্পনাবিলাসী বিধায় ধরে নিচ্ছি উত্তরটা হচ্ছে- টাইম মেশিন!

যদি টেসলাকে বিন্দুমাত্র অনুভব করতে চান, তাহলে আপনার রুমে যান। লাইট, ফ্যান সব বন্ধ করে দিন। মোবাইল ফোন বন্ধ করে দিন। ইন্টারনেট থেকে লগআউট করে কম্পিউটার শাট ডাউন করে দিন। রুমে চলতে থাকা টিভি, রেডিও সব বন্ধ করে দিন। এবার খাটে বা চেয়ারে ৫টা মিনিট চুপ করে চোখ বন্ধ করে বসে থাকুন আর ভাবুন কেমন অনুভব করছেন?

নিকোলা টেসলা ছাড়া আমাদের জীবনটাও ঠিক এমনই হতো! নিকোলা টেসলা তাই আমাদের কাছে বিজ্ঞানের জগতের ‘দ্যা ডার্ক নাইট’।